করোনায় স্কুল বন্ধ: প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতা হারিয়েছে শিশুরা

দেশে কভিডের সংক্রমণ শুরুর কয়েকদিনের মাথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তা খুলে দেয়া হয় একটানা ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর। বন্ধের সময় অনলাইন এবং রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য দূরশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হয়। তবে দেশে সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে এসব কার্যক্রমের সুবিধা পায়নি। সরকারের বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া প্রভাবিত হয়। একই সঙ্গে স্কুলে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ না নেয়ায় অনেক শিশুই তাদের প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতা হারিয়েছে বলে জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথভাবে ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেনস এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১’ শিরোনামে এ সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। এ সমীক্ষা চালাতে গিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সারা দেশে নয় হাজার খানার শিশু ও অভিভাবকদের তথ্য নেয়া হয়। এতে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। দীর্ঘ সময় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষণ দক্ষতা ও শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার ওপর স্কুল বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব খতিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে এটি পরিচালিত হয়। এছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও শিশুদের জীবনাচারে শৃঙ্খলার ওপর সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত না থাকায় প্রভাব নিরূপণও এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল।

এতে উঠে আসে, ২০১৯ সালেও ৭-১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ বই পড়তে ও সাধারণ যোগ-বিয়োগ করার মতো বিষয়গুলো সঠিকভাবে পারত। ২০২১ সালে এসে এ হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশে। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে এমন শিক্ষার্থীর হার ২৯ শতাংশ ও গ্রামে ২৫ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মৌলিক জ্ঞান কমার ক্ষেত্রে অভিভাবকরা বেশ কয়েকটি কারণকে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ থাকা, পরিবারের আয় কমে যাওয়া ও শিশুর অনিচ্ছার মতো বিষয়গুলোর কথাই উঠে এসেছে বেশি। দূরশিক্ষণ (অনলাইনে শিক্ষা) নিতে না পারার কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, ঘরে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস, টিভি ও রেডিও না থাকা মূল প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৯ সালে মাল্টিপল ইন্ডিগেটর ক্লাস্টার সার্ভে তথ্যপ্রযুক্তি, পড়া ও গণনার দক্ষতাসহ বিভিন্ন দক্ষতার বিষয়ে একটা সমীক্ষা করা হয়। করোনার কারণে যখন ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকে, তখন শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতার বিষয়ে জানা প্রয়োজন ছিল। বিবিএসের সঙ্গে ইউনিসেফ ২০১৯ সালে একই নির্দেশিকা মেনে ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালে জানুয়ারিতে তথ্য সংগ্রহ করে। এ সমীক্ষায় বোঝার চেষ্টা করা হয়, দুই বছরে নির্দেশকগুলো কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। তবে এ জরিপ প্রকৃত চিত্র উপস্থাপনা করছে না, কারণ আমরা একই শিশুর কাছে যাইনি। ২০১৯ সালে যেসব শিশুর দক্ষতা দেখা হয়েছিল, তাদের কাছে ২০২১ সালে গেলে প্রকৃত চিত্র বোঝা যেত।

তিনি জানান, প্রাথমিক, নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিকের সব পর্যায়ে একই ফলাফল আসেনি। কোথাও কোথাও অবস্থার উন্নতিও হয়েছে। প্রাথমিকে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও স্কুলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে, তবে তা ছিল আগের ধারণার চেয়ে কম। স্কুল বন্ধ থাকায় প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতা শিক্ষার্থীদের কিছুটা কমেছে। তবে এটা কখনই দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা শুধু ধারণা নেয়ার জন্য করা হয়েছিল। দূরশিক্ষণ পদ্ধতির সুবিধা পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে এর হার বেড়েছে। দূরশিক্ষণের সুবিধা প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা তেমন কমেনি। দূরশিক্ষণের বিষয়গুলো প্রস্তুত রেখে দুর্যোগকালীন সবাইকে সমানভাবে সুবিধা দিতে পারলে আপত্কালীন সময়ে এর সুফল পাওয়া যাবে।

সমীক্ষায় উঠে আসে, স্কুল বন্ধের প্রভাবে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও স্কুলে ভর্তি না হওয়ার হার বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার বয়সী ৬ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু স্কুলের বাইরে ছিল। ২০২১ সালে এসে এমন শিশুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশে। এর মধ্যে গ্রামে রয়েছে ১৬ শতাংশ ও শহরে রয়েছে ১৪ শতাংশ। নিম্ন মাধ্যমিকের বয়সে ২০১৯ সালে ১৩ শতাংশ থাকলেও তা ২০২১ সালে ১৬ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকের বয়সে ২০১৯ সালে ৩২ শতাংশ থাকলেও ২০২১ সালে এমন কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি। একইভাবে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি হয়েও স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এসে এ হার ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। একইভাবে নিম্ন মাধ্যমিকেও ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হয়েছে ২০২১ সালে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়নি।

স্কুল বন্ধের সময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং এবং টেলিভিশন ও রেডিওতে পরিচালিত দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। শহরের ২৯ শতাংশ ও গ্রামীণ ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব কার্যক্রমে অংশ নেয়। এর মধ্যে প্রাথমিকে ১৩, নিম্ন মাধ্যমিকে ২০ ও উচ্চ মাধ্যমিকে ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে।

মহামারীর আগে শিক্ষার্থীরা স্কুল, বাড়িতে ও গৃহশিক্ষকের কাছে দিনে ৬ ঘণ্টা সময় পড়াশোনায় ব্যয় করেছে। তবে করোনা শুরুর পর তা নেমে আসে মাত্র ২ ঘণ্টায়। এতে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সময় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে তাদের দক্ষতাও। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিশুদের মধ্যে এ প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে বই পড়া, লেখা ও অংক করার মতো বিষয়ে দক্ষতা কমে গিয়েছে।

সারা বিশ্বে করোনায় শিক্ষা খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করোনায় এক ধরনের বাধ্য হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। এ সময় অনলাইনে, রেডিও-টেলিভিশনের শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়। গত দুই বছরে শিক্ষার্থীরা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা গবেষণা করেছে। ইউনিসেফের ফলাফলও তেমন। বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা গবেষণা করে দেখেছে, করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিক্ষা খাত। এর শিখন পদ্ধতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এ সময় সরকার বিকল্প পদ্ধতির ব্যবস্থা করলেও সব শিক্ষার্থীরা তার সমান সুযোগ পায়নি। এমন বাস্তবতায় অনেক শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়েছে। তবে ঠিক কত শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বা স্কুলের বাইরে থেকেছে তার সঠিক হিসাব আমরা কেউ জানি না। শুধু প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।

তার মতে, আগামীতে দুর্যোগে শিক্ষা কার্যক্রমে সব শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা উচিত। প্রস্তুতি ও পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা থাকতে হবে। করোনার আঘাত মোকাবেলার জন্য স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বাকি সবগুলো খাত যেমন গুরুত্ব পেয়েছিল শিক্ষা তেমন গুরুত্ব পায়নি। মন্ত্রণালয় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। দুর্যোগের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলেও তা বাস্তবিক অর্থে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগেনি।

মহামারীতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতার ওপর প্রভাবের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধে শিক্ষার্থীরা কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি, যারা পিছিয়ে পড়েছে তারা যেন দ্রুত তা কাটিয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে আগামীতে এমন দুর্যোগে প্রস্তুত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: