করোনার নতুন ঢেউয়ে সংক্রমণ বাড়ছে

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রায় তিন মাস নিম্নমুখী ছিল। চলতি মাসের প্রথম থেকে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। সর্বশেষ গত এক সপ্তাহে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যাও আগের সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে কয়েক গুণ। শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যায় আবারো ঊর্ধ্বগতিকে সংক্রমণের নতুন ঢেউ বা পর্যায় হিসেবে দেখছেন রোগতত্ত্ব ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনার নতুন ধরন বা উপধরনগুলো সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নতুন কোনো ধরন শনাক্ত করা যায়নি। তবে বেশি করে নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করলে হয়তো নতুন ধরন শনাক্তের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে চলমান পরিস্থিতি আরো অবনতিরও শঙ্কা রয়েছে।

গত চার এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এ সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ২১০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্তের হার তখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল না। এ সপ্তাহে একজনের মৃত্যু হলেও মৃত্যুর হার পূর্ববর্তী এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহের তুলনায় নিম্নমুখী ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ৬ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। এ সময়ে ৪৫৮ জনের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হলে আগের সপ্তাহের তুলনায় তা ১১৮ শতাংশ বেশি হয়। ১৩ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ২ হাজার ২১২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় শনাক্তের হার সপ্তাহের ব্যবধানে ৩৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ দুই সপ্তাহের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়নি। সর্বশেষ ২০ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সাতদিনে কভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছে ৮ হাজার ৮৪৬ জন। তাতে সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্তের হার দাঁড়ায় ২৯৯ শতাংশে।

গত সপ্তাহে নয়জনের মৃত্যু হওয়ায় মৃত্যুর হার পূর্ববর্তী সপ্তাহের তুলনায় ৯০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত চার এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহে ক্রমান্বয়ে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৩ শতাংশ নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হয়। এতে সর্বশেষ সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৬৬ হাজার ৭৫৮টি। যদিও একইভাবে গত সপ্তাহে বেড়েছে সুস্থতার হার।

বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিকে দেশে করোনার পঞ্চম ঢেউ বা পর্যায় বলে মন্তব্য করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমার মতে গত ফেব্রুয়ারিতে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছিল চতুর্থ পর্যায়ের সংক্রমণ। ২০২০ সালের শুরুতে করোনার প্রথম ঢেউ শুরু হয়। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলফা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে শুরু হয়ে মার্চে করোনার বিটা ধরন দিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হয়। একই বছরে এপ্রিলে (ঈদের পরে) গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ। সেটা ছিল তৃতীয় ঢেউ, যা আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অনেকেই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে আগস্ট পর্যন্তকে বলে দ্বিতীয় ঢেউ। কিন্তু আমি বলি এ সময়ে দুটি ঢেউ ছিল। চতুর্থ ঢেউ হচ্ছে ওমিক্রন ধরনের সংক্রমণ, যা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। আর এখন হচ্ছে পঞ্চম ঢেউ।

সব ভাইরাসের আচরণ এক নয় উল্লেখ করে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা নিলে বা আক্রান্ত হলে এর কোনো স্থায়ী প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠছে না। যেসব দেশ খুব কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেসব দেশে অন্তত ছয় মাস পরপর ঢেউ আসে। আর বাংলাদেশের মতো যারা স্বাস্থ্যবিধি মানে না তাদের ক্ষেত্রে তিন বা আড়াই মাস পরপর আসে। কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সংক্রমিত হলে প্রাকৃতিকভাবে যে ইমিউনিটি হয় সেটা তিন থেকে ছয় মাস স্থায়ী হচ্ছে। টিকা নিলেও তা তিন থেকে চার মাস আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে। তবে যারা আগে টিকা নিয়েছে বা আক্রান্ত হয়েছে তারা গুরুতর অবস্থা থেকে রেহাই পাচ্ছে। কিন্তু যারা টিকা নেয়নি কিংবা টিকা নিলেও দীঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্তরা করোনা হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১৩ হাজার ৪৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করলে ২ হাজার ৮৭ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণ বাড়ার মধ্যে টানা দ্বিতীয় দিন দুই হাজারের বেশি কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬১। গতকাল সর্বশেষ আরো তিনজন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ১৪৫।

করোনাভাইরাসের ওমিক্রনের সংক্রমণ দেশে কিছুটা কমে এলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা হাজারের নিচে নেমে আসে। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৬ মার্চ দৈনিক শনাক্ত কমে একশর নিচে দাঁড়ায়। মে মাসের শুরুতে দৈনিক নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১ শতাংশের নিচে নেমে আসে। তবে ওই মাসের শেষের দিকে শনাক্তের সংখ্যা ফের বাড়তে শুরু করে। এতে ১১ সপ্তাহ পর গত ১২ জুন দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ১০০ অতিক্রম করে। আর গত সোমবার এ সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। গতকাল দৈনিক শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শতকরা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সর্বশেষ আরো ২০০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠায় মোট সুস্থতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭ হাজার ৬৭।

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ১২৬টি হাসপাতালে ১২ হাজার ৯৮৮টি সাধারণ শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখানে ভর্তি রয়েছে ৩৬১ জন করোনা রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মোটেও মানা হচ্ছে না। সংক্রমণের তীব্রতা কম তাই মানুষ পরীক্ষাও করে না। এতে আক্রান্ত মানুষটি অন্যদের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। গত ঢেউগুলোতেও পরীক্ষা করার সংখ্যাটা খুব বেশি না থাকলেও এখনকার থেকে অনেক বেশি ছিল। আগের ঢেউগুলোয় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছুটা হলেও আইসোলেশনে থাকত।

স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে এ জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, বর্তমানে এক-দুজন করে মৃত্যু হচ্ছে, হঠাৎ করে এটা বেড়েও যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন— ডায়াবেটিস, কিডনি, ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপে ভোগা ব্যক্তি ও বয়োবৃদ্ধরা আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যু প্রভাবিত হবে। এখনো বহু ব্যক্তি বুস্টার ডোজ টিকা নেয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে ছয়টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ নির্দেশনায় বলা হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে সব গণমাধ্যমে অনুরোধ জানাতে হবে। সব ক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম যথাসম্ভব বর্জন করতে হবে। ধর্মীয় প্রার্থনার স্থানগুলোয় (যেমন মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি) মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এছাড়া জ্বর, সর্দি, কাশি বা কভিড-১৯-এর উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দোকান, শপিং মল, বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবাইকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান করতে হবে। অন্যথায় তাকে আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন।

করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ বা পর্যায় শুরু হয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, বলা হচ্ছে চতুর্থ বা পঞ্চম ঢেউ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি তো সরকারিভাবে বলার কিছু নয়। আমাদের দেশে ৮০ শতাংশ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ দেয়া যায়নি প্রায় একই সংখ্যক মানুষকে। তৃতীয় ডোজ দিলেও যে সংক্রমণ কমবে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক দেশে চতুর্থ ডোজ দেয়ার পরও সংক্রমণ কমানো যায়নি। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই। অনেক দেশে ঘোষণা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে, তবে আমাদের দেশে এমন কিছুই করা হয়নি। তবুও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা নেই বললেই চলে।

উল্লেখ্য, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে প্রথম মৃত্যুর কথা জানায় সরকার।

Source: Bonik Barta

Share the Post: