কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যু ব্যাংকিং: নীতিমালা না থাকায় চালু হচ্ছে না পরিষেবা

বর্তমানে দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা পাচ্ছে নাগরিকরা। তবে কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যুর সংরক্ষণ বা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা না থাকায় বহু রোগের চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশে তা গড়ে ওঠেনি। ফলে চিকিৎসার জন্য অনেকেই যাচ্ছে বিদেশে। দেশ থেকে বিদেশে কর্ড ব্লাড, কর্ড টিস্যু ও রক্তের নমুনা ব্যাংকিং পরিষেবার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ব্যাংকিং সেবা চালু করা গেলে ৮০টিরও বেশি জটিল রোগের চিকিৎসা সহজ হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ থেকে বিদেশে কর্ড ব্লাড, কর্ড টিস্যু ও রক্তের নমুনা ব্যাংকিং করে গবেষণায় বিদেশই লাভবান হবে। আর জীবনের সংকটকালে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় এসব উপাদান পাচারের শঙ্কাও রয়েছে।

তারা বলছেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থাটি দেশে হওয়াই উত্তম। বিষয়টি কঠিন কিছু নয়। শুধু সরকারি উদ্যোগ ও কিছু অবকাঠামো প্রস্তুত করতে পারলে দেশে এ পরিষেবা চালু করা যায়। দেশ থেকে বিদেশে কর্ড ব্লাড, টিস্যু ও রক্তের নমুনার ব্যাংকিং করে এ নিয়ে যে গবেষণা হবে তাতে বাংলাদেশ তেমন একটা লাভবান হবে না। অন্যদিকে এসব উপাদান পাচার হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু কর্ড ব্লাড এখন আর চিকিৎসার বর্জ্য নয়, বরং স্টেম সেলের একটি মূল্যবান উৎস। শিশুর জন্মের পর এটি ফেলে না দিয়ে সংরক্ষণ করলে ৮০টির বেশি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরে পরিবারের সদস্যসহ অন্য মানুষ স্টেম সেল নিয়ে রোগের চিকিৎসা করতে পারে।

জানা যায়, দেশ থেকে বিদেশে রক্তের নমুনা, কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যু ব্যাংকিং সেবা চালুর জন্য সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। আবেদনের বিষয়টি নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে প্রেরিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক চিঠির সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান ভারতের কর্ড লাইফ সায়েন্স-ইন্ডিয়া থেকে মা ও শিশু বিভাগের নির্দিষ্ট কিছু ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা জন্য কর্ড ব্লাড, কর্ড টিস্যু ব্যাংকিং পরিষেবা প্রদান করতে চায়। পরীক্ষার মধ্যে বিশেষ করে রয়েছে জেনেটিক, মলিকুলার, বায়োকেমিক্যাল ও ইমিউনোলজিভিত্তিক পরীক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশে এসব পরীক্ষা হয় না। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের থ্যালাসেমিয়া ও অটিজমসহ ৮০টি রোধের চিকিৎসার দ্বার উন্মোচন হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি টিস্যু নমুনাগুলো দেশের বাইরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত কিট বাক্সের মাধ্যমে পাঠাবে। ডায়াগনস্টিক ও কর্ড ব্লাড ব্যাংকিং পরিষেবার জন্য রক্তের নমুনা, কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যু দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মতামত চায় অধিদপ্তর।

তবে চিঠির বিষয় অবগত নন উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, আমার আগের পরিচালক এ চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে কী হয়েছে তা এখন বলতে পারব না। তবে চিঠির জবাবে কোনো উত্তর দেয়নি মন্ত্রণালয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত কোনো কিছুর অনুমোদনে অধিদপ্তরের কাছে মন্ত্রণালয় মতামত চায়। আর এখানে অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চেয়েছিল। ফলে চিঠির জবাব দেয়নি মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে এ ব্যাংকিং পরিষেবা চালুর জন্য কোনো নীতিমালা নেই। নীতিমালা প্রণয়নের জন্য মন্ত্রণালয় শিগগিরই কাজ শুরু করবে। ব্যাংকিং পরিষেবার অনুমতি পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অবেদনকারী প্রতিষ্ঠানটি গত ৩০ নভেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর নাভির মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে তার সংযোগ থাকে। শিশুর নাভিতে কর্ড থাকে। এর মধ্যে যে রক্ত থাকে তাকে কর্ড ব্লাড বলা হয়। এ কর্ডের মধ্যেই ৫০০-৭০০ মিলিলিটার রক্ত থাকে। সেই রক্তে থাকে স্টেম সেল। এ রক্তই সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত ১০০ মিলিলিটার রক্ত নিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এর সঙ্গে কর্ডের কিছু অংশ (২৬ সেন্টিমিটার) সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়। শিশুর জন্মের পরই এ কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতে হয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে হবে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এটি সংরক্ষণ করতে হয়। কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি খরচসাপেক্ষ। সাধারণত ন্যূনতম ২১ ও সর্বোচ্চ ৭৫ বছর পর্যন্ত কর্ড ব্লাড ব্যাংক করা হয়।

কর্ড ব্লাড হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেলসমৃদ্ধ, যা দিয়ে পরে শিশুর ব্লাড ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, অটিজম, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, আলসারসহ ৮০টির বেশি রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। ফলে এ কর্ড ব্লাডের মধ্যে যে স্টেম সেল রয়েছে তা থেকে শিশুর ভবিষ্যৎ অনেক রোগের সময় কাজে লাগানো যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বণিক বার্তাকে বলেন, লিউকেমিয়ার জন্য বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হয়। সেক্ষেত্রে একজন ডোনার (দাতা) প্রয়োজন পড়ে। স্টেম সেল সংরক্ষণ করা গেলে ডোনারের প্রয়োজন পড়বে না। এ স্টেম সেল দিয়ে তার লিউকেমিয়ার চিকিৎসা করা যাচ্ছে। এতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না।

তার মতে, যেসব রোগের চিকিৎসার কথা বলা হচ্ছে সেসবের মধ্যে অনেক রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাংলাদেশে নেই। এ সেবা চালু হলে প্রয়োজনীয় বহু পরীক্ষা চালু হবে। এতে চিকিৎসাও সহজ হবে। তবে দেশেই এ ব্যাংকিং সেবা চালু করা উচিত। অন্যথায় বিদেশে ব্যাংকিং করলে তারাই গবেষণা করে লাভবান হবে। এজন্য বেশকিছু বিষয় সামনে রেখে কাজ করতে হবে। লোকবল, অবকাঠামো, নীতিমালাসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ লাগবে।

ব্যাংকিং পরিষেবা চালুর জন্য নীতিমালা নেই উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ বণিক বার্তাকে বলেন, এ ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে চিকিৎসা অনেক সহজ হচ্ছে। দেশেই এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এখান থেকে সংগ্রহ করে বিদেশে সংরক্ষণ করা হলে তেমন ফল আসবে না। এতে বিদেশীরাই উপকৃত হবে। যখন সেবা নেয়ার জন্য মানুষ আগ্রহী হবে তখন প্রয়োজনীয় পরীক্ষাও বাংলাদেশে চালু হবে। এ ব্যাংকিং পরিষেবা প্রথমে সরকারিভাবে হওয়া উচিত। কারণ সরকারিভাবেই বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: