সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনামূল্যে খাওয়ার স্যালাইন (ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট বা ওআরএস) সরবরাহ করছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির খাওয়ার স্যালাইন উৎপাদনের পাঁচটি আঞ্চলিক ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সিংহভাগই আমদানি হয়। তবে কাঁচামাল সংকটের কারণে সম্প্রতি রংপুর ও বরিশালের দুই ইউনিটের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ইউনিটগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, যার প্রভাবে এসব অঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে খাওয়ার স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডায়রিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে অবস্থিত পাঁচটি ইউনিটের মাধ্যমে ওআরএস উৎপাদন করা হচ্ছে। বছরে মোট প্রায় সাড়ে তিন কোটি প্যাকেট ওআরএস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের। সরকারি এ স্যালাইন বিনামূল্যে পায় সাধারণ মানুষ। ঢাকার বাইরের চারটি ইউনিটের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন। আর ঢাকার ইউনিট পরিচালিত হয় সরাসরি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, জনস্বাস্থ্যের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে একটি অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির লক্ষ্যে ওআরএস উৎপাদন প্রক্রিয়া রয়েছে। ওআরএসের চারটি উপাদান (গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম ক্লোরাইড ও ট্রাইসোডিয়াম)। তীব্র ডায়রিয়াজনিত রোগের কারণে শরীরে পানিস্বল্পতা পূরণ করতে খাওয়ার স্যালাইন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম তীব্র ডায়রিয়াজনিত রোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিহাইড্রেশনের কারণে এসব মৃত্যু হয়।
মূলত এ চার উপাদানের অভাবে দেশে সরকারিভাবে খাওয়ার স্যালাইন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের জন্য স্থাপিত রংপুর ইউনিটে ১৬ নভেম্বরের পর থেকে ওআরএস উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। একইভাবে গত সপ্তাহে বন্ধ হয়েছে বরিশালেও।
রংপুর ইউনিটের দায়িত্বে থাকা জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. রুহুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কাঁচামালের অভাবে স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।’
রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই ইউনিটে মজুদ স্যালাইন দিয়ে দুই সপ্তাহের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলার সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বছরে প্রায় ৬০ লাখ প্যাকেট ওআরএস ইউনিটটিতে উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাওয়ার স্যালাইনের চাহিদা রয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বিশেষায়িত এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মাসে ৫০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন সরবরাহ করতে হয়। আর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি মাসে দরকার হয় ৩০ হাজার প্যাকেট। এছাড়া বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও দিনাজপুরে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসিক খাওয়ার স্যালাইনের চাহিদা ২০ হাজার প্যাকেট করে।
রংপুর স্যালাইন ইউনিটের স্টোরকিপার মো. এনামুল হক জানান, বর্তমানে ২ লাখ ৯০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন মজুদ রয়েছে। প্রতিদিন ২২ হাজার প্যাকেট স্যালাইন তৈরি হয়। নভেম্বরে চাহিদা হচ্ছে সাড়ে চার লাখ প্যাকেট স্যালাইন। উৎপাদিত ওআরএস রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের চার সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সব জেলা হাসপাতাল, দুই সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন পৌরসভা, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক ও কেন্দ্রীয় কারাগারে সরবরাহ করা হয়।
একইভাবে কাঁচামাল না থাকায় বরিশাল ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে ২১ নভেম্বর। জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে প্রায় ১৫ দিন কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ ছিল। বিভাগটির ছয় জেলার বাইরে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে ওআরএস সরবরাহ করে এ ইউনিট। দৈনিক ১৯ হাজার প্যাকেট উৎপাদন সক্ষমতার ইউনিটটি থেকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বছরে প্রায় ৪৫ লাখ প্যাকেট ওআরএস সরবরাহ হয়।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, ‘কাঁচামাল না থাকার কারণে স্যালাইন উৎপাদন করতে পারছি না। চাহিদা অনুযায়ী ওআরএস উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা নেই। এখনো প্রায় চার লাখ প্যাকেট মজুদ রয়েছে।’
এদিকে কাঁচামালের সরবরাহ না থাকলে এক সপ্তাহ পর যশোর ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ পর স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খুলনা বিভাগের সব জেলায় এ ইউনিট থেকে স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। বিভাগের বাইরের জেলা থেকে চাহিদা পেলে সেখানেও দেয়া হয়।’
জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যশোর ইউনিটে দৈনিক ১৫ হাজার প্যাকেট স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। গত বছর প্রায় ২৮ লাখ প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউনিটটির কাঁচামাল সংকটের কথা এরই মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে জানানো হয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জন্য কুমিল্লার ওআরএস উৎপাদন ইউনিটে এখনো সংকট দেখা দেয়নি বলে দাবি করেছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আকতার। তিনি জানান, কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায় স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী এখনো ওআরএস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকার ওআরএস উৎপাদন ইউনিটের তত্ত্বাবধানে সরাসরি কাজ করছে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এ ইউনিট ও বাকি চার ইউনিটের দায়িত্বে রয়েছেন আইপিএইচের উপপরিচালক ডা. মো. দুলাল হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকার ইউনিটের জন্য যে পরিমাণ কাঁচামাল রয়েছে তাতে আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত উৎপাদন চলবে। কাঁচামালের জন্য গত বছর দরপত্র করা হয়। তবে অর্থবছরের মধ্যে ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি। চলতি অর্থবছরে এটি শুরু করা হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কাঁচামাল পাওয়া যাবে আশা করছি। তবে স্যালাইনের সংকট দেখা দেবে না, কেননা পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।’
সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় জটিলতার জন্য ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংকট ও জটিলতা যেকোনো ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া যদি স্বভাবিকভাবে চলে সেক্ষেত্রে সঠিক সময়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কোনো কোনো সময় বরাদ্দের পর্যাপ্ততা থাকে না, আবার বরাদ্দ পর্যাপ্ত থাকলেও সঠিক সময়ে কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে না।
মজুদ থাকলেও উৎপাদন বন্ধ থাকাকালীন চাহিদা বেশি হয়ে গেলে ঘাটতি দেখা দেয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উৎপাদন বন্ধ হলেও তারা যদি সরবরাহ ঠিক রাখতে পারে তাহলে তো ভালো। তবে মজুদ থাকার পরও যদি চাহিদা বেড়ে যায় তবে বড় ধরনের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউনিটগুলো থেকে কাঁচামাল সংকটের কথা আমাদের জানিয়েছে। কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য গত জুলাই-আগস্টের দিকে ই-জিপি করা হয়েছে। এ কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যারা দরপত্র প্রস্তাব জমা দিয়ে ক্রয়াদেশ পান তাদের কেউ কেউ কাঁচামাল আমদানি করে আবার কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। কাঁচামালের সংকট হঠাৎ করে নয়। গত অর্থবছরে ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করে যায়নি। আমরা ইউনিটগুলোয় খোঁজ নিয়েছি, সেখানে স্যালাইনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রংপুর, যশোর ও বরিশাল প্রতিনিধি)