রাজধানীতে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তন্ময় শিকদারের (ছদ্মনাম) দুই চোখ। বেশি ক্ষতি হয় ডান চোখের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এ তরুণের চোখে এরই মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়েছে, তবে দৃষ্টিশক্তি আর ফেরেনি।
পুরান ঢাকার একটি কারখানায় কাজ করেন তন্ময়। মায়ের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার সকালে তন্ময় কাজে যাচ্ছিলেন। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে চোখে আঘাত পান তিনি।
ঢামেকে চক্ষু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নেন গাজীপুরের টঙ্গীর কিশোর আহসান হাবীবও (ছদ্মনাম)। টঙ্গীর একটি কলেজে পড়েন তিনি। রাজধানীর উত্তরায় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ছররা গুলিতে তার ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চোখে অস্ত্রোপচার হলেও দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
শুধু তন্ময় বা হাবীব নন, গত কয়েক দিনে চোখে টিয়ার গ্যাসের শেল বা গুলির আঘাত নিয়ে শতাধিক রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এদের কেউ কেউ এরই মধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
একই অবস্থা রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। গত পাঁচদিনে বিশেষায়িত এ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন প্রায় ৪০০ রোগী।
চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত চোখের আঘাত নিয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৩৯৫ জন। এদের মধ্যে ৩০৮ জন ভর্তি হন। অস্ত্রোপচার হয় ২৫৬টি। এসব রোগীর সিংহভাগই গুলি কিংবা টিয়ার গ্যাসের শেলের কারণে চোখে আঘাত পেয়েছেন।
পরিচালকের কার্যালয় থেকে বণিক বার্তাকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রোগীর চাপ বেশি ছিল। শনিবার চাপ কিছুটা কম ছিল। রোগীদের তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার জন্য ১১টি অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) একসঙ্গে চালু করা হয়।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে তিন-চারদিন ধরে যেসব রোগী এসেছেন, তাদের বেশির ভাগই সংঘর্ষ ও সহিংসতায় চোখে আঘাত পেয়েছেন।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সাদা ও কালো অংশ মিলিয়ে পুরো চোখকে বলা হয় আইবল। আর পিউপিল হলো মণির ভেতরের ছোট অংশ, যেখানে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আর চোখের পিউপিল বাদে বাকি কালো অংশকে বলা হয় কর্নিয়া। আর আছে রেটিনা। এসব অংশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপরে চিকিৎসা নির্ভর করে।
অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা জানান, আইবলে আঘাত পেলে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি বেশি থাকে। চোখের পাতায় আঘাত লাগলে সাধারণত দৃষ্টিশক্তি হারায় না। গুলি আইবলে বা একটু গভীরে আটকে গেলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা গেলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে আশঙ্কামুক্ত করা যায়। আইবলের একটু ভেতরে গেলেও অস্ত্রোপচারে সম্ভব। তবে এর বেশি ঢুকে গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে বাঁচানো কঠিন। কারো চোখে কাঁদানে গ্যাস লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চক্ষু বিভাগ ও চক্ষু সার্জারি বিভাগে বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত শতাধিক রোগী ভর্তি হন, যা শয্যাসংখ্যার চেয়েও বেশি। এদের প্রায় অর্ধেকের চোখে ছররা গুলির আঘাত লেগেছে। কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকের।
গত কয়েক দিনের সহিংসতা ও গোলাগুলিতে ঠিক কতজন চোখে আঘাত পেয়েছেন, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। সাধারণত যেসব হাসপাতালে জরুরি ব্যবস্থাপনায় চোখের চিকিৎসা মেলে, সেসব হাসপাতালে বেশি রোগী গিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল শীর্ষে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কখনো কখনো গুলি চোখ ভেদ করে পেছনের হাড়ে বাধা পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চোখের দৃষ্টি ফেরানো না গেলেও রোগীকে বাঁচানো যায়। তবে ওই হার ভেদ করে গুলি আরো ভেতরে গেলে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তখন চোখের পাশাপাশি মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’