দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। চলতি বছর এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মৃতের হার অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। আর বয়সভিত্তিক বিভাজনে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছেন ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীরা। যদিও ঠিক কী কারণে এ বয়সী নারীদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে তা বলতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, এ বয়সী নারীর মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সেই কারণ নিশ্চিতভাবে বলার জন্য যে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন, তা করা হচ্ছে না।
দেশে যেকোনো রোগ বিশেষ করে প্রাদুর্ভাবের পর্যায়ে পড়লে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকাও রাখে এসব প্রতিষ্ঠান। ২৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগতত্ত্বের জায়গায় গুরুত্ব পেলেও এ রোগের বিষয়ে বয়স ও এলাকাভিত্তিক বিশেষ গবেষণা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। ফলে কী কারণে নির্দিষ্ট কোনো বয়সী নারী ও পুরুষের মধ্যে ডেঙ্গু রোগের প্রবণতা বেশি হচ্ছে, কেন তারা মারা যাচ্ছে তা নিয়েও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে।
ডেঙ্গুবিষয়ক রোগী ও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের প্রতিষ্ঠানটি শুধু হাসপাতালে (নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল) যেসব রোগী ভর্তি হয় ও মারা যায় তাদের তথ্যই প্রদান করে। গতকাল সন্ধ্যায় যে তথ্য দেয়া হয়, তাতে রাজধানীর ছয়টি সরকারি ও ২৯টি বেসরকারি হাসপাতালের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য সংযুক্ত করা হয়নি। অসম্পূর্ণ এ তথ্য অনুযায়ী গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৮৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে একজনের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর সারা দেশে ২৮ হাজার ৪৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর মারা গেছে ১৫৬ জন। এ সময়ে রাজধানী ঢাকায় সাড়ে ১৭ হাজার ভর্তি রোগীর মধ্যে ১২২ জন ও সারা দেশে সোয়া আট হাজার ভর্তি রোগীর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বয়সভিত্তিক হিসাবে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহারে সবচেয়ে এগিয়ে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। মোট মৃত্যুর ৪০ শতাংশ এ বয়সী নারী ও পুরুষ। আর তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছে নারীরা। এ বয়সী মৃত মোট ৬২ জনের মধ্যে ৪৩ জনই নারী। শতকরা হিসাবে ৬৯ শতাংশ নারী ও ৩১ শতাংশ পুরুষ। বাকিদের মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী আটজন, পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী আট, ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১৭, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৩৬, ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সী ২২ এবং ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার হিসাবে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মোট রোগীর সোয়া নয় হাজারই এ বয়সী পুরুষ। এ বয়সী রোগাক্রান্ত নারীদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।
রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, চিকিৎসকের কাছে দেরিতে আসার কারণে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার বেশি। একই সঙ্গে এ বছর এডিস মশার আচরণ পরিবর্তন ও ভাইরাসের রূপান্তরের কারণে মৃত্যু প্রভাবিত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা গবেষণা না থাকায় এ বয়সী নারীদের মৃত্যু বেশি হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলা যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকা ও চিকিৎসকের কাছে দেরিতে যাওয়ার প্রবণতার কারণে তাদের মৃত্যু বেশি হতে পারে। আবাসিক এলাকা অথবা বাড়িতে এডিস মশা থাকায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া এ বয়সী নারীদের অনেকেই গর্ভবতী, ফলে তাদের ঝুঁকি বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কেন ডেঙ্গুতে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করতে হলে রোগতত্ত্বের জায়গায় ব্যাখ্যা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেখতে হবে, তাদেরকে কখন হাসপাতালে আনা হচ্ছে, তাদের আগে সংক্রমণের ইতিহাস রয়েছে কিনা, দেরিতে হাসপাতালে আনা হচ্ছে কিনা, চিকিৎসায় কোনো অবহেলা রয়েছে কিনা, পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অবহেলা ছিল কিনা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো জানার জন্য যাকে আমরা অটোপসি (পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা বা ময়নাতদন্ত) বলে থাকি, তা করা প্রয়োজন। তখন হয়তো সুনিশ্চিতভাবে বলা যাবে। যদি দেখা যায়, আগে তারা ডেঙ্গুতে দুই-তিনবার সংক্রমিত হয়েছে, তাহলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অথবা তাদেরকে হাসপাতালে দেরিতে আনা হয়েছে, ততক্ষণে হয়তো মাল্টি অর্গান ফেইলিউর (বহু অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়া) হয়ে গেছে, রক্তচাপ বেড়ে গেছে। এতে শক সিনড্রোম হয়েছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে হরমোনাল একটা পার্থক্য রয়েছে, সেটা তো আমরা করোনায় দেখেছি।’
তার মতে, রোগতাত্ত্বিকভাবে কোনো রোগকে বিশ্লেষণ করতে হলে যেসব তথ্য সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন তার চল বাংলাদেশে নেই। যদিও অনেক দেশ সুচারুভাবে এসব তথ্য নিয়ে থাকে। ভবিষ্যতে রোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকৌশল নেয়ার ক্ষেত্রে এসব তথ্য প্রয়োজন হয়। যদি নির্দিষ্ট কোনো বয়সের মানুষের মৃত্যু বেশি হয়, তবে সেই মৃত্যু কমানোর কোনো সুযোগ আছে কিনা তার কৌশল নেয়া যায়। সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হলে অটোপসি করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে অটোপসি বলা হয়, আইনগতভাবে সেটাকে পোস্টমর্টেম বলা হয়। কাটাছেঁড়া না করেও রোগীর ইতিহাস মৌখিকভাবে নিয়েও এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা যায়। সেক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্টগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ডেঙ্গু রোগে যারা মারা যাচ্ছে তাদের মৃত্যুর কারণ বিশেষ করে বয়সভিত্তিক বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ শিগগিরই করা হবে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. শাহ আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আইইডিসিআর এ বিষয়ে দ্রুতই কাজ করবে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সভা হবে। এরপর বলা যাবে।’
এখন এ বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেছি। কমিটিও করা হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে জানানো হবে।’
আইইডিসিআর এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
এদিকে ডেঙ্গুবিষয়ক সরকারি তথ্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে শুরু থেকেই। বিষয়টি গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকারও করে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই সময় জানানো হয়, মূলত রাজধানী ঢাকায় ২০টি সরকারি ও ৫০টি বেসরকারি হাসপাতালে যেসব ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে তাদের তথ্য দেয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে জেলা হাসপাতালের তথ্য দেয়া হচ্ছে। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারা দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে তার তথ্য নেই। এমনকি হাসপাতালের বাইরে যেসব রোগী বাড়িতে রয়েছে তাদের তথ্যও সরকারের পক্ষ থেকে রাখা হচ্ছে না। পর্যবেক্ষণও করা হচ্ছে না।
দেশে প্রথম ২০০০ সালে ডেঙ্গুকে রোগতত্ত্বের জায়গা থেকে গুরুত্ব দেয় সরকার। সে বছরই সাড়ে পাঁচ হাজার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। ২০২২ সালে ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। সে বছর দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে গত ২২ বছরে (২০২৩ বাদে) দেশে আড়াই লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছে ৮৫০ রোগী।