কারাবন্দিদের চিকিৎসা অপ্রতুল, এখনো ভরসা সাধারণ হাসপাতাল

প্রতি বছরই দেশে বাড়ছে কারাবান্দির সংখ্যা। কোনো কোনো কারাগারের সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে। তবে শুরু থেকেই উপেক্ষিত থাকছে বন্দিদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি। প্রয়োজনীয় জরুরি ও বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যদিও বিভিন্ন জেলায় কারাবন্দিদের জন্য স্বতন্ত্র কারা হাসপাতাল নির্মাণ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে সেভাবে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়নি। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাপনা। শুধু ভবনেই সীমাবদ্ধ এসব হাসপাতাল। ফলে জরুরি ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য বন্দিদের নেয়া হচ্ছে জেলা, জেনারেল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে কারাবন্দিদের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অবহেলা করা হচ্ছে।

কারা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জনের। সেখানে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্দি ছিল ৯৫ হাজার ৬৭৭ জন। এসব বন্দির চিকিৎসায় কারা হাসপাতালগুলোয় স্থায়ী পদ রয়েছে ১৪১টি। তবে কর্মরত রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। অর্থাৎ ১৩৬টি পদই শূন্য রয়েছে। তবে সিভিল সার্জন অফিস থেকে কারা হাসপাতালগুলোয় দু-একজন চিকিৎসক সংযুক্ত থাকেন। তারা সপ্তাহে দুদিন কারাগারে চিকিৎসা দেন।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ ও ২ এবং হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার মিলিয়ে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। এসব বন্দির চিকিৎসায় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ২০০৩ সালে গড়ে তোলা হয় ২০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল। এখানে অসুস্থ বন্দিদের দ্রুত চিকিৎসা দিতে রয়েছে উন্নত মানের অস্ত্রোপচার কক্ষ, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ও প্যাথলজি ল্যাব। চিকিৎসা দিতে একজন তত্ত্বাবধায়ক, দুজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট, নয়জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পাঁচজন আবাসিক চিকিৎসক, নয়জন মেডিকেল অফিসার, দুজন সহকারী সার্জন, একজন প্যাথলজিস্ট, দুজন রেডিওলজিস্ট, দুজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ডিপ্লোমা নার্সসহ ৩৩টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় বন্দিদের চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

কারাসংশ্লিষ্টদের দাবি, দীর্ঘদিন বন্দি জীবন ও বার্ধক্যসহ নানা কারণে বন্দিরা যক্ষ্মা, টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তাদের চিকিৎসার জন্য কারাগারগুলোয় হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। কিন্তু কারা হাসপাতালে জনবলের অভাবে অসুস্থ বন্দিদের নিতে হয় কাছাকাছি থাকা অন্য কোনো হাসপাতালে। চিকিৎসা পেতে বিলম্বের কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকে হৃদরোগে আক্রান্তরা।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারগারের কর্মকর্তারা জানান, সেখান থেকে তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। গুরুতর অসুস্থ বন্দিদের হাসপাতালে পাঠানোর প্রস্তুতি, নিরাপত্তা, রাস্তায় যানজটসহ সব মিলিয়ে হাসপাতালে নিতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। কারাগারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত বন্দিকে কারা হাসপাতালে প্রাথমিক সেবা দিয়ে দ্রুত নেয়া হয় তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অনেক সময় কারাগার থেকে হাসপাতালে স্থানান্তরের পথে চিকিৎসায় বিলম্বের ফলে পথেই মৃত্যু হয় বন্দিদের।

রাজশাহী বিভাগের আটটি কারাগারে বন্দিদের চিকিৎসার জন্য ৮৮ শয্যার একটি কারা হাসপাতাল রয়েছে। তবে সেখানে নিজস্ব কোনো চিকিৎসক নেই। ফার্মাসিস্টের পদেও কেউ নেই। তাই রাজশাহী সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে একজন চিকিৎসককে এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। তাকে জানানো হয়, দেশের কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বন্দির চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে প্রেষণে আসা অল্পসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে। কারা কর্তৃপক্ষ গুরুতর রোগীদের অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করাচ্ছে। পরে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিকেল ইউনিট গঠনের নির্দেশ দেন।

কারা চিকিৎসকরা জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) বন্দিদের চিকিৎসার জন্য ১৭২ শয্যার চারতলাবিশিষ্ট কারা হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে জরুরি বিভাগ ও ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর জন্য চিকিৎসক আছেন দুজন, নার্স দুজন ও ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন একজন। অথচ কম করে হলেও ১০ জন চিকিৎসক দরকার। পাশাপাশি পাঁচজন সেবিকা ও দুজন ল্যাব টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। এছাড়া ফিজিওথেরাপি মেশিন ও ফিজিওথেরাপিস্ট কোনোটাই নেই। স্ট্রোকজনিত রোগের কারণে প্যারালাইসিস রোগীদের থেরাপি দিতে হয়। তাছাড়া আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনও নেই।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় কারাবন্দিদের চিকিৎসায় প্রিজন সেল রয়েছে। এসব সেল তদারকি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত কারা অধিদপ্তরের। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব কার্যক্রম পরিচালনা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অন্যান্য রোগীর মতোই সমান অধিকার দেয়া হয়। কোনো তারতম্য নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রয়েছে ১২টি শয্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত একটি চারতলা ভবনে অবস্থিত এ সেলে কারাবন্দিদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. রেজাউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারাবন্দিদের চিকিৎসা সাধারণের মতোই দেয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ কোনো বন্দিকে নিয়ে এলে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধীনে ভর্তি করানো হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র, করোনারি কেয়ার ইউনিট অথবা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সেলে রাখার সুযোগ নেই। চিকিৎসার জন্য তাদের বিভাগগুলোয় পাঠানো ও ভর্তি করা হয়। রোগ নিরীক্ষা, চিকিৎসা ও ওষুধের ক্ষেত্রে সবাইকে সমান সেবা দেয়া হয়।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রয়েছে ১২টি শয্যার প্রিজন সেল। এখানে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগে ভর্তি করা হয়। আর স্বাভাবিক চিকিৎসার জন্য সেলে রাখা হয়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শামীম আহসান বলেন, ‘কারাবন্দিরা যখন চিকিৎসার জন্য আসে তখন তারা রোগী। সেখানে অন্য কোনো পরিচয় দেখা হয় না। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের প্রিজন সেলে রাখা হয়। এখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের।’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনালের ডা. এফএম শামীম আহাম্মদ জানান, ২০টি শয্যা নিয়ে প্রিজন সেলের কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১০ শয্যার প্রিজন সেল সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে সভা হয়েছে। এ সেলে বর্তমানে আটজন রোগী ভর্তি রয়েছে। রোগী বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।’

কারাগারে বন্দিদের চিকিৎসা সংকটের বিষয়টি অধিদপ্তরের অংশীজন সভায় জানিয়েছেন ময়মনসিংহ বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, ‘সহকারী সার্জন ছুটিতে থাকাকালে বন্দিদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়।’ সহকারী সার্জনের ছুটিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডাক্তার পদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধি ও কারা মহাপরিদর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

করাবন্দিদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিকেল ইউনিট গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইউনিট গঠনের কাজ শেষ হলে অনুমোদিত পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে। কারা হাসপাতালগুলোতেই বন্দিরা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা পাবে। বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।’

বন্দিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো অসমতা করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা সবার জন্য সমান হতে হবে। কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারাবন্দি ও অন্যান্য রোগীর জন্য চিকিৎসার প্রটোকল একই। একজন সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে যে যোগ্যতার চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সুবিধা থাকবে তা কারাবন্দিদের ক্ষেত্রেও সমান থাকবে। তারা হাসপাতালে বন্দি হিসেবে আসে না। তারা রোগী। এখানে অন্য কোনো পরিচয় ভাবার সুযোগ নেই। শুধু তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ ওই বন্দি যেন পালিয়ে যেতে না পারে, আত্মহত্যা করতে না পারে অথবা কেউ যেন ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা থাকবে। এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যাতে ওই বন্দির মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: