কিডনি প্রতিস্থাপন-পরবর্তী জটিলতা সিংহভাগ রোগীর

বাংলাদেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন হয় ১৯৮২ সালে তত্কালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হলেও দেড় মাসের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন প্রথম কিডনিগ্রহীতা। এরপর তীব্র জটিলতার কারণে ৩২ বছর বয়সী ওই তরুণের মৃত্যু ঘটে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কিডনিগ্রহীতার অস্ত্রোপচার-পরবর্তী বিভিন্ন মেয়াদি জটিলতা দেখা যাচ্ছে। প্রতিস্থাপন পরবর্তী ক্ষত নিরাময়, রক্তপাত, সংক্রমণ ঝুঁকি, রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অসামঞ্জস্য ও প্রতিস্থাপিত কিডনি শরীরে খাপ না খাওয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো বড় অস্ত্রোপচারের পর রোগীর শরীরে মৃদু অথবা মারাত্মক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো জটিল অস্ত্রোপচারের ফলে পরবর্তী সময়ে রোগীর শরীরে জটিলতা দেখা দেয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়মিত চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে এসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠা যায়।

বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে হাসপাতালটিতে ৫০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিস্থাপনের পর এসব রোগীর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদি জটিলতা দেখা যায়। কিডনিগ্রহীতাদের ৪০ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা গেছে। আবার প্রতিস্থাপিত কিডনি রোগীর শরীরে খাপ না খাওয়ায় তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যাকে অ্যাকুইট গ্রাফট রিজেকশন বলা হচ্ছে। ২৬ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২ শতাংশ কিডনি গ্রহীতা। কিডনি প্রতিস্থাপন-পরবর্তী সাধারণ ও গুরুতর ডায়াবেটিস বা পোস্ট ট্রান্সপ্লান্ট ডায়াবেটিস মেলিটাসে (পিটিডিএম) আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ শতাংশ রোগী। আর সাইটোমেগাভাইরাসের (সিএমভি) সংক্রমণ ঘটেছে ৮ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে।

প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক ও গবেষক শেখ ডা. মইনুল খোকন বণিক বার্তাকে জানান, প্রত্যক ব্যক্তির কোষ, টিস্যু ও অঙ্গগুলোর ভিন্নতা রয়েছে। জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এমনটি হয়। শরীরের যে কার্যক্রম অন্য কোষ ও টিস্যু থেকে নিজস্ব কোষ ও টিস্যু শনাক্ত করে তাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বলা হয়। এসব সিস্টেম যখন ভিন্ন কোনো কোষ বা টিস্যুর সন্ধান পায়, তখন তা থেকে শরীরকে রক্ষার জন্য ধ্বংসের চেষ্টা করে। যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শরীরের ক্ষতিকর ও ত্রুটিপূর্ণ কোষকে সরিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে অন্য কিডনিরও সবসময় শরীরে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হতে পারে। যাকে কিডনি প্রত্যাখ্যান বলা হয়। তিন-চার ধরনের প্রত্যাখ্যান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হলো অ্যাকুইট গ্রাফট রিজেকশন (তীব্র প্রত্যাখ্যান)।

কিডনি ও ইউরোলজি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি সংযোজনের সবচেয়ে বড় বাধা কিডনিগ্রহীতার শরীর নতুন কিডনি গ্রহণ না করা ও শরীরে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হওয়া। অস্ত্রোপচারের পর ছয় মাস রোগীকে বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে হয়। প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনিগ্রহীতার শরীর দাতার কিডনি প্রত্যাখ্যান করলেও তা ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, উচ্চরক্তচাপ ও নতুন করে ডায়াবেটিস হতে পারে।

প্রতিস্থাপন-পরবর্তী বিভিন্ন মেয়াদি তীব্র ও মৃদু জটিলতা সৃষ্টি হলেও সব ক্ষেত্রে কিডনি বিকল হয় না বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের পর নিউমোনিয়া, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত কিডনি কাজ না-ও করতে পারে। কিন্তু এসব জটিলতা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি নয়। তবে সব জটিলতায় কিডনি বিকল হয় না। নিয়মিত ওষুধ সেবন ও পর্যবেক্ষণে থাকলে অনেকাংশে জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়।

প্রতিস্থাপনের পর কিডনিগ্রহীতাদের বেঁচে থাকার সময়সীমার ব্যাপারে কিডনি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলেছে, কিডনি প্রতিস্থাপনের পর এক বছর বাঁচতে পারে রোগীদের ৯৫ শতাংশ। দুই বছরের মাথায় এ সংখ্যা ৯০ শতাংশে দাঁড়ায়। আর পাঁচ বছরের মাথায় কিডনিগ্রহীতাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ বেঁচে থাকে বা প্রতিস্থাপিত কিডনি কাজ করে। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত কিডনির কার্যকারিতা কমতে থাকে।

চিকিৎসকরা বলছেন, যেকোনো বড় অস্ত্রোপচারের পর বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এসব সংক্রমণ ৪০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে হলেও তা নিরাময় সম্ভব। নিয়মিত ওষুধ সেবন ও সাবধানতা অবলম্বনে কিডনিগ্রহীতাদের সংক্রমণ রোধ করা যায়। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। মুখের ফোলা ভাব, ওজন বৃদ্ধি, রক্তে উচ্চশর্করা ও রক্তচাপ, হাড়ের রোগ, চোখে ছানি, অ্যাসিডিটি ও ত্বকের পরিবর্তনের মতো প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু ওষুধ ক্যান্সারের ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে এসব সেবন করলে রোগীর লিভার বা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। পেট কেটে অস্ত্রোপচারের ফলে বয়স্ক, স্থূল ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জটিলতা বেশি হয়। কিছু রোগীর ইউরিনে রক্তপাতও দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশে এক ব্যক্তির শরীরে দ্বিতীয়বারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়নি। তৃতীয়বার এবং প্রয়োজনে আরো বেশিবার কিডনি প্রতিস্থাপন করা গেলে যাদের কিডনি প্রতিস্থাপনের পরও সমস্যা রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে করেন বিনা পারিশ্রমিকে দেশে সর্বাধিক কিডনি প্রতিস্থাপনকারী চিকিৎসক ও সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের পর জটিলতা কিছুটা থাকতে পারে। তবে যেসব জটিলতা দেখা যায়, তার ৯০ শতাংশের বেশি নিরাময় করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। অন্যান্য রোগও দেখা দিতে পারে। তবে নিয়মিত ওষুধ সেবন ও পরিচর্যায় থাকলে তা প্রতিরোধ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত কিডনি শরীরে কাজ করে না। সেক্ষেত্রেও ওষুধ রয়েছে। ১০ শতাংশের কম রোগীর ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপনের কিছুদিন পর তা বিকল হয়ে যায়। এজন্য আবারো কিডনি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশ এক ব্যক্তির শরীরে পাঁচবারও কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে। বাংলাদেশে আমরা এখনো তৃতীয়বার কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারিনি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: