প্রতি বছরই দেশে কিডনি রোগী বাড়ছে। দেশে ১০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। এখানে পিছিয়ে সরকারি হাসপাতাল। এ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে তার মাত্র ২৭ শতাংশ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। সমন্বয়হীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রহের অভাবে সরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন কম হচ্ছে বলে মনে করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিডনি প্রতিস্থাপন জটিল চিকিৎসা প্রক্রিয়া। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগ বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। এ পর্যন্ত সারা দেশে ১০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ৩০৭টির মতো কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে হয়েছে ৬২৫টি।
সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন বাংলাদেশ (এসওটি), বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ৫৮০টি, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৩৫টি, ঢাকা মেডিকেলে পাঁচটি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে ১ হাজার ৬২টি, এভারকেয়ার হাসপাতালে ২১টি ও ইউনাইটেড হাসপাতালে ৩৯টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। এছাড়া বারডেম ও পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও প্রতিস্থাপন হয়েছে। তবে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পপুলারে কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেলে ২০০৮ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। ২০১৩ সালের পর বন্ধ হয়ে যায় কার্যক্রম। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে কিডনি প্রতিস্থাপন পুনরায় শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ।
কিডনি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা মহামারীর কারণে গত দুই বছর কিডনি প্রতিস্থাপন বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় বন্ধ ছিল। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য যে সংখ্যক নেফ্রোলজি ও ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে চিকিৎসা যন্ত্রাংশসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা অনেক হাসপাতালে নেই। অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন সোসাইটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের আলোকে কিডনি, যকৃৎ, হূদপিণ্ড ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে। কোন কোন হাসপাতালকে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে অনুমতি দেয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত প্রস্রাবে প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ ও খাদ্যাভাস্যের কারণে কিডনি রোগ হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ বংশগত। যেসব রোগ কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নিয়মিত পরীক্ষা করলে শুরুতে সমস্যা শনাক্ত করা যায়। একটি কিডনি নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলে অন্যের দেহ থেকে নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করতে হয় অথবা তাকে ডায়ালাইসিস করে বাঁচতে হবে। সেক্ষেত্রে আজীবন ডায়ালাইসিস করতে হবে।
কিডনি শরীরে প্রবাহিত সব রক্ত ছেঁকে পানির সঙ্গে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কিডনি বিকল হলে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কৃত্রিমভাবে বর্জ্য বের করতে ডায়ালাইসিস করতে হয়। সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয় এমন কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রতি বছর ৩৫ হাজার বলে জানান কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক ও গবেষক শেখ ডা. মইনুল খোকন।
দেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। বিনা পারিশ্রমিকে নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে ১ হাজার ৬২টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ১৪ বছর ধরে কিডনি প্রতিস্থাপন করে যাচ্ছেন ডা. কামরুল। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে রোগী বেশি থাকলেও প্রতিস্থাপন কম হওয়ার কারণ প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধের অভাব। সরকারি চিকিৎসকদের করপোরেট বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিয়ে যায়। এতে সরকারি হাসপাতাল বঞ্চিত হয়।
কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে সমন্বিত উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ হাসপাতালেও দীর্ঘদিন কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ ছিল। আমি যোগদানের পর শুরু করেছি। সারা দেশের বড় বড় হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন জোরদার করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই জটিল চিকিৎসা। এখানে সহযোগী অনেক কিছু প্রয়োজন হয়। সরকারিভাবে আটটি বিভাগীয় শহরে কিডনি, ক্যান্সার ও কার্ডিয়াকের বিশেষায়িত চিকিৎসা শুরু করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।