রাজধানীর আলাতুন্নেসা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মোহাম্মদ কেফায়েত (ছদ্মনাম)। মধ্য বাড্ডার ইউলুপের নিচে বসে ১৯ জুলাই সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ বাধলে তার পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। বর্তমানে ওই স্কুলশিক্ষার্থী জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। ধীরে ধীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় জীবন বাঁচাতে হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে গুলিবিদ্ধ তার ডান পা-টি। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি সংক্রমণ। তাই আবারো অস্ত্রোপচার করা হতে পারে বলে পরিবারকে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
কিশোর কেফায়েতকে সময়মতো চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ স্বজনদের। আহতাবস্থায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরলেও ভর্তি নিতে চায়নি। এ বিষয়ে তার চাচা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য আমার ভাতিজাকে নিয়ে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি অন্তত পাঁচটি হাসপাতালে ঘুরেছি। কোনোটিই ভর্তি করতে রাজি হচ্ছিল না। সবাই জানিয়ে দেয়—এখানে চিকিৎসা সম্ভব নয়! তাই অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেই কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। এ সময়ের মধ্যে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলিতে ওর পায়ের ধমনি ও শিরা ছিঁড়ে গেছে।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত সপ্তাহে সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে কেফায়েতের শয্যার ঠিক উল্টো পাশেই ভর্তি রয়েছেন মিষ্টির দোকানের কর্মচারী আবিদ (ছদ্মনাম)। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর চিটাগং রোডে সংঘর্ষে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন এ তরুণ। হাঁটুর নিচ থেকে তারও বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে আরো কয়েক সপ্তাহ। তবে আক্ষেপ, এখন থেকে পুরোটা জীবনই চলতে হবে এক পায়ে ভর দিয়ে।
কেফায়েত কিংবা আবিদই নয় কেবল, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি বেশ কয়েকজনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে, যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় আহত হয়েছেন। গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, সম্প্রতি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালটির ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডেই কেবল ভর্তি হন ৩৪ জন। এর মধ্যে পায়ে গুলি লেগেছে ২৭ জনের। ছয়জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বাকি সাতজনের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অন্যান্য ওয়ার্ডের চিত্রও প্রায় একই রকম।
আহত রোগীর অঙ্গ কেটে ফেলা প্রসঙ্গে নিটোরের ইয়োলো-১ ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব রোগী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং রক্তনালি বা ধমনি ছিঁড়ে গেছে তাদের পা কাটতে হয়েছে। কেননা এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাংস পচে যাবে বা মরে যাবে। এতে পরবর্তী সময়ে রোগীর শারীরিক অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। কিডনিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোগীকে বাঁচাতেই আক্রান্ত অঙ্গটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন চিকিৎসক।’
যেসব রোগীর পা কাটা হয়েছে তারা এখনই সুস্থ হয়ে যাবেন তেমনটা ভাবার উপায় নেই জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘কাটা পায়ে সেলাই করতে হবে আরো পরে। কেননা কাটা জায়গা থেকে রস পড়বে। তা শুকাতে হবে। ফলে অনেক রোগীকে হাসপাতালে দীর্ঘ সময় রাখতে হয়। কোনো কোনো রোগীর অবস্থা ভালো হলে তাকে বাড়ি পাঠাই এবং দুই-তিন সপ্তাহ পর আসতে বলি। যদি দেখা যায় তার হাড় ও মাংসে সংক্রমণ কমেনি এবং রস পড়া বন্ধ হয়নি তখন আবারো অস্ত্রোপচার করতে হয়। প্রতিটি রোগীর অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। আর যেসব রোগীর পায়ের হাড় গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে ভেঙেছে তাদের ওই ক্ষত শুকাতে হবে। এরপর অস্ত্রোপচার। তা না হলে সংক্রমণ হয়। এসব রোগীর ক্ষেত্রে অনেক দিন সময় লেগে যায়।’
এদিকে হাসপাতাল পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুলাই সকাল ৭টা থেকে গতকাল সকাল ৭টা পর্যন্ত পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন ১ হাজার ৬৯৩ রোগী। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ রোগী ২৪১। তবে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২১৪ গুলিবিদ্ধ রোগী আসে ১৯ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে।
তাদের মধ্যে কোনো কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল জানিয়ে হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়ক সাবিত্রী রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘যেসব রোগী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাদের বেশির ভাগকেই ভর্তি করা হয়েছে। তাদের সবারই জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। কারো কারো বড় ধরনের অস্ত্রোপচার বাকি রয়েছে এখনো। তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসকরা অপেক্ষা করছেন।’
কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতার সময় অন্যান্য দিনের তুলনায় রোগীর চাপ অনেকটাই বেড়ে যায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে। তাই অনেক চিকিৎসক ও হাসপাতাল স্টাফের ছুটি বাতিল করা হয় বলে জানান পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান। গতকাল দুপুরে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে সাধারণত সব সময়ই রোগীর চাপ থাকে। এরপরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় কিছু রোগী বেড়েছিল। আমাদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়েছে। অনেকের ছুটিও বাতিল করা হয়েছিল।’
চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব রোগী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাদের জরুরি অস্ত্রোপচার করে রাখা হয়েছে। কিন্তু বড় অস্ত্রোপচার করতে সময় লাগবে। কেননা তাদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ও সংক্রমণ রোধ করে তবেই অস্ত্রোপচারে যেতে হবে।’