রাজধানী ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় করোনার সংক্রমণ এখন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রোগীর চাপে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেখা দিচ্ছে জরুরি চিকিৎসা উপকরণের সংকট। দ্রুত সরবরাহ চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্রও পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর এ চাহিদা পূরণ করতে পারছে না অধিদপ্তর। রাজধানীর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) অধিকাংশ জরুরি চিকিৎসা উপকরণেরই মজুদ এখন শেষ।
দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১২৭টি হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে ৯৯টি সরকারি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের মধ্যে ৪৫টিতে কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। রাজধানী ঢাকায় এমন সরকারি হাসপাতাল রয়েছে দুটি। অন্যদিকে দেশের নয় জেলায় সংকটাপন্ন কভিড-১৯ রোগীদের জন্য জরুরি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করা হয়নি। এছাড়া রেমডিসিভির ইনজেকশনসহ অন্যান্য জরুরি উপকরণও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এসব জেলার সংকটাপন্ন রোগীরা বিভাগীয় শহর বা পাশের জেলায় ভিড় করছেন।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগার সূত্রে জানা গিয়েছে, এতদিন মজুদ সাপেক্ষে অধিদপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী কিছু কিছু যন্ত্রাংশ ও উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। এখন এর মধ্যে বেশ কয়েকটিরই মজুদ শেষ হয়েছে। বর্তমানে সিএমএসডিতে কোনো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, রেমডিসিভির ইনজেকশন, কভিড-১৯ টেস্টিং কিট ও ভেন্টিলেটর নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুদ নেমে এসেছে পাঁচ হাজারে। এছাড়া সেখানে ৭০০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও ১০০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে।
দেশে করোনার চলমান প্রবাহ মারাত্মক আকার নেয়া শুরু করে মার্চে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সময়ে সারা দেশেই নতুন করে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও উপকরণের চাহিদা তৈরি হয়। সে সময় হাসপাতালসহ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাহিদাপত্র সংগ্রহ করে দেয়া হয় সিএমএসডিকে। এরপর দিনে দিনে এ চাহিদার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু আগের চাহিদাপত্রে চাওয়া সরঞ্জাম ও উপকরণের সংস্থান করতে পারেনি সিএমএসডি। বর্তমানে জরুরি সরঞ্জাম ও উপকরণের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে এসব উৎস থেকে পাওয়া উপকরণ খুবই অপ্রতুল।
যদিও সংক্রমণের চলমান প্রবাহ শুরুর পরপরই সিএমএসডিতে মজুদ ফুরিয়ে আসার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। গত এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে সিএমএসডিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের মজুদ ছিল মোট চাহিদার ৩৯ শতাংশ। সিএমএসডির কাছে ওই সময়ে ৩ হাজার ৯১টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২ হাজার ২১৬টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ৯৩৭টি আইসিইউ শয্যা (মনিটরসহ), ৭৩৬টি ভেন্টিলেটর ও ২১ হাজার ২৭৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার চেয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু এর বিপরীতে মজুদ ছিল ৩৩০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২ হাজার ২০০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ৩০৭টি আইসিইউ বেড, ১০৭টি ভেন্টিলেটর ও ৮-১০ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার। এছাড়া ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৫৯টি রেমডিসিভির ইনজেকশন, ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪টি আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট ও প্রচুরসংখ্যক ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্রয় জটিলতা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে চাহিদাপত্র দেয়ার আড়াই মাস পরও এসব সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি।
মজুদ শেষ হওয়ার আগে এপ্রিলেই এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল সিএমএসডি। পরে তা ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনও পায়। যদিও এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো ক্রয়াদেশ দেয়া হয়নি।
বর্তমানে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে পাওয়া উপকরণ দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও ব্যক্তির থেকে প্রাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। তবে তা নিতান্তই অপ্রতুল। সরকারিভাবে কিনতে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারকে বলা হয়। তাতে কিছুটা সময় লাগে।
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় সংক্রমণ প্রবাহের আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে কভিডের সংক্রমণ বেড়েছে। গতকালও ৮৫ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই মাসে সর্বোচ্চে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
মে মাসের শুরুতে করোনার ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সংক্রমণ শনাক্তের হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। এসব জেলায় এখন জরুরি চিকিৎসা উপকরণের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। ভারত সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহে পরীক্ষার বিপরীতে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ৪১ শতাংশ। জেলার সরকারি করোনা হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রচুর কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী এসে ভিড় করছে। এক মাস ধরেই জেলার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। যদিও এত রোগীকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেয়ার মতো জরুরি উপকরণের সংস্থান কোনো হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানে নেই। মে মাসে এ নিয়ে অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র দিয়েছে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু সিএমএসডিতে না থাকায় তা দিতে পারছে না অধিদপ্তর।
সীমান্তবর্তী আরেক জেলা কুড়িগ্রামেও প্রায় একই অবস্থা। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো আইসিইউ সুবিধা যুক্ত হয়নি। ফলে সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের বিভাগীয় শহর রংপুরে পাঠাতে হয়।
হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে নেত্রকোনা জেলায়। গত মাসে চাহিদাপত্র দেয়া হলেও এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. সেলিম মিঞা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান বণিক বার্তাকে বলেন, মজুদ শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে কাজ করেছি। আমরা শুধু আদেশ অনুযায়ী কিনে দিই। আমরা চাহিদা সৃষ্টি করি না। মহামারীর সময়ে চাহিদা অনুযায়ী উপকরণের সংস্থানে আমরা বিলম্ব করছি না।