কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় দেশে অর্ধসহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এর ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে। এ ধরনের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় ঢাকা বিভাগে, ১৭১ জনের।
এ হিসাব পাওয়া গেছে কেবল সরকারি হাসপাতালের নিবন্ধিত মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় নিহতদের তথ্য এতে যোগ হয়নি। আবার সরকারি হাসপাতালের অনেক মৃত্যু হিসাবের বাইরে থেকে গেছে। কারণ কিছু ক্ষেত্রে নিবন্ধনের আগেই স্বজনরা মরদেহ নিয়ে চলে গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত দেশের জেলা, উপজেলা, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে তারা হতাহতদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা গেছে, সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ৪০৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু হয় (ব্রট ডেথ) ২৯০ জনের, যা মোট নিহতের ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ভর্তি হওয়ার পর বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় (অ্যাডমিটেড ডেথ) মারা যায় ১১৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ আহত হয়। ঢাকা বিভাগে আহত হয় ১০ হাজার ৫৭৬ জন। মৃত্যু হয় ২৩৮ জনের। এর মধ্যে হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় ১৭১ জনের। চট্টগ্রাম বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ জনের। এর মধ্যে হাসপাতালে নেয়ার আগে মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। এর বাইরে হাসপাতালে নেয়ার পথে খুলনায় ২৬, সিলেটে ২১, রংপুরে ১৩, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে নয়জন করে এবং বরিশালে দুজনের মৃত্যু হয়।
মোট মৃত্যু হিসাবে চট্টগ্রামের পরই আছে খুলনা। এ বিভাগে মৃত্যু হয় ৩৫ জনের। এর বাইরে রংপুরে ২৬, রাজশাহী ও সিলেটে ২৩ জন করে, ময়মনসিংহে ১২ ও বরিশালে দুজনের মৃত্যু হয়।
আহতের সংখ্যায় ঢাকার পরই রয়েছে চট্টগ্রাম। এ বিভাগে আহত হয় ১ হাজার ৯৩২ জন। এর বাইরে বরিশালে ১ হাজার ৪৪২, রংপুরে ১ হাজার ২১৩, রাজশাহীতে ৯৯৭, সিলেটে ৯৯৫, খুলনায় ৯৭৫ ও ময়মনসিংহে ৪৪৬ জন আহত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও তথ্য চাওয়া হয়েছিল। তবে কেউ তথ্য দেয়নি। যেসব মরদেহ সরকারি হাসপাতালে আনা হয়, সেগুলোর সব নথিভুক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন রাজধানীর তিনটি টারশিয়ার (বিশেষায়িত) হাসপাতালের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালের নথিতে মৃতের তথ্য প্রকৃত নয়। হাসপাতালে নিয়ে আসা মরদেহের অর্ধেক মর্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। যারা মরদেহ নিয়ে এসেছিলেন, তারা এতটাই বিক্ষুব্ধ ছিলেন যে তাদের সঙ্গে ঠিকভাবে কথাও বলা যায়নি। মৃতের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধরা মরদেহ নিয়ে চলে গেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো মরদেহের মৃত্যুসনদ লেখা সম্ভব হয়েছিল; আবার কোনোটি জরুরি বিভাগের দরজা থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি বিভাগে মৃত ঘোষণার পর মর্গে না গেলে তার নিবন্ধন হয় না। ফলে হিসাবও রাখা যায় না।’
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি মরদেহ আসে ঢামেক হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে। আন্দোলন চলাকালীন এসব হাসপাতালে সরজমিনেও অনেক মরদেহের নিবন্ধন না হওয়ার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পরদিন (৬ আগস্ট) ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছু আহত ব্যক্তি আমাদের কাছে আসার পরই মারা যান। আবার কিছু ব্রট ডেথ হাসপাতালে আনা হয়। আমাদের এখানে মারা যাওয়া বা মৃত অবস্থায় আনা হলে সেসব মরদেহ মর্গে রাখি। আর যেসব ক্ষেত্রে পুলিশ কেস হয়, ছাত্র আন্দোলনের সবই পুলিশ কেস, সেক্ষেত্রে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। এরপর মরদেহ দেয়া হয় স্বজনদের কাছে। কিছু মরদেহ মর্গের নিবন্ধন ও ময়নাতদন্ত ছাড়া স্বজনরা নিয়ে গেছেন। নিবন্ধনের আগেই মরদেহ নিয়ে যাওয়ায় সঠিক হিসাব রাখা কঠিন।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহে সরকার কাজ করছে। হতাহতদের তালিকা করার জন্য এরই মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সব ধরনের মৃত্যুর তালিকা তৈরি করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মুহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায় পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। কোনো তথ্যই বাদ পড়বে না। কমিটিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিবসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, অর্থ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে।’