কৌশল নির্ধারণ করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর: বন্ধ হচ্ছে অক্সফোর্ডের টিকা প্রয়োগ

দেশে গতকাল পর্যন্ত ২১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৯ জন দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিতে বাকি রয়েছে। তবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এ টিকার মজুদ রয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮০ হাজার ডোজ। এতে প্রথম ডোজ গ্রহণকারী সাড়ে ১৪ লাখ ব্যক্তি এ টিকা পাবে না। যদিও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ছাড়াও ভিন্ন উৎস থেকে অক্সফোর্ডের এ টিকার সন্ধান করছে সরকার। সেসব উত্স থেকে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় এ টিকা প্রয়োগ বন্ধ করা হবে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা দিয়ে দেশে গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধক টিকাদান কার্যক্রম। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি এ টিকার সাড়ে তিন কোটি ডোজ কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সরকার। তবে পরিকল্পনামাফিক টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। টিকার সংস্থান না হওয়ায় প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া নিয়েই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এদিকে ঘাটতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় কৌশলও নির্ধারণ করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহের পর শেষ হয়ে যাবে মজুদ থাকা টিকা। ফলে এরপর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাবে না দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষ। এ সময় টিকার প্রয়োগ বন্ধ করে নির্ধারিত সময় পরে নতুন করে অন্য কোনো টিকা তাদের দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে শিগগিরই কোভিশিল্ডের টিকা পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে এর আগে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে টিকা রফতানিতে সেরামকে দেয়া ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজনীয় টিকা পাচ্ছে না কোভ্যাক্স। এ টিকার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় উৎপাদকের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করা যেত। সেখান থেকেও টিকা পাওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করা যেত। তবে সরকার শুধু সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

টিকার সরবরাহ সংকট বিবেচনায় নিয়ে ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ প্রয়োগ বন্ধ করে সরকার। তবে টিকার সংকটের বিবেচনায় প্রথম ডোজ প্রয়োগ বন্ধ করলেও তা বিলম্বিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ প্রাপ্তদের দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ধারিত সংখ্যক ব্যক্তিদের অন্য কোনো টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া গেলে ভালো হতো। তবে এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্য কোনো সংস্থা এখনো একমত হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য কোনো টিকা দেয়ার সুযোগ নেই। কোভিশিল্ডের ঘাটতি মোকাবেলায় আরো এক মাস সময় রয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডোজের সংস্থান না হলে এ টিকা প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

প্রয়োজনীয় সংখ্যক কোভিশিল্ডের ডোজ নিশ্চিত করতে না পারলে তা প্রয়োগ বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোভিশিল্ড টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের মধ্যে যারা দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না তাদের নতুন করে টিকা দেয়া হবে। নতুন কোনো টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে। শুরুতে আমরা যখন টিকা কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলাম তখন অক্সফোর্ডের এ টিকা ছাড়া অন্য কোনো টিকা আমাদের জন্য যথাযথ ছিল না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘাটতি মোকাবেলায় অনেক দেরিতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা নিশ্চিত করতে আর কোনো ভুল করা যাবে না। অক্সফোর্ডের টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা আমলে নিয়ে বাকি পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। দেশের ১৩ কোটির বেশি মানুষকে টিকা দিতে হবে। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সমন্বয়হীনতার কারণে অক্সফোর্ডের টিকার ঘাটতি হয়েছে। সময় অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রোধে স্বাস্থ্যবিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা প্রয়োজন। যার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী বলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথম ডোজ প্রাপ্তদের মধ্যে যারা দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না তাদের আরো এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তাতে ক্ষতি হবে না। এ সময়ে মধ্যে সরকারকে বহুবিধ কাজ করতে হবে। মানুষকে অস্থির না হতে বলা এবং তাদের কর্মপ্রণালি জানাতে হবে। গত মার্চে যখন ভারত সরকার সেরামকে টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিল তখনই সরকারের উচিত ছিল টিকা কার্যক্রমের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা। তখনই প্রথম ডোজ বন্ধ করে দিলে এ ঘাটতি হতো না। তখন সরকার কী বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে তা বলা মুশকিল। সরকার সব সময় ভাবে তারা যা করছে তা সঠিক। কিন্তু বিষয়টি সহজ হয়নি। মানুষকে বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়নি।’

গত ৮ এপ্রিল থেকে দেশে কোভিশিল্ড টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৯৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৫ জন নারী ও পুরুষ প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯১২ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৮৩ জন।

অক্সফোর্ডের টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষমাণরা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য টিকা নিতে পারবেন না বলে জানান ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপের (নাইট্যাগ) সদস্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অক্সফোর্ডের টিকা প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজ অন্য টিকা নেয়ার সুযোগ নেই। এজন্য যারা দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না তাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে সরকার কৌশল ঠিক করতে পারছে না। প্রথম ডোজ নেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের জন্য তিন মাস বা তারও কিছু বেশি সময় ব্যবধান হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে ঘাটতি টিকার সংস্থান না হলে আবারো প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে ১৪ লাখ ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না তারা নতুন করে অন্য টিকা নেবেন। কোথাও থেকে অক্সফোর্ডের টিকার সংস্থানের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা প্রয়োগ শুরু করে সরকার। বর্তমানে চল্লিশোর্ধ্ব এবং অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকা দেয়া হচ্ছে। এ টিকার জন্য স্থানীয় উৎপাদক ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত নভেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম আগাম পরিশোধ করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। মার্চে টিকা রফতানিতে স্থগিতাদেশ জারি করেছে ভারত সরকার। এরপর সেরাম থেকে আর কোনো টিকা পায়নি বাংলাদেশ। কেনা টিকার ৭০ লাখ ডোজ ছাড়াও ৩২ লাখ ডোজ উপহার পাঠায় ভারত।

টিকার সংকট দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গত ৬ মে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারের সঙ্গে বৈঠকের পর এমন তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। যেকোনো উপায়ে এ টিকা সংগ্রহের কথা ভাবছে সরকার। তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

Source: Bonik Barta

Share the Post: