স্বাস্থ্য খাতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি। গ্রামীণ ও নগর দরিদ্রদের মধ্যে রোগটির প্রকোপ বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান দূষণ, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবকে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিআরএইচ) পরিসংখ্যানেও দেখা গিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির শনাক্তকৃত ক্যান্সার রোগীদের ৮০ শতাংশই স্বাক্ষরজ্ঞানহীন ও স্বল্পশিক্ষিত।
কৃষিতে স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব চর্চা থেকে বিরত থাকছেন কৃষক। বাড়ছে ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রয়োগ। নগর দরিদ্রদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বাড়াচ্ছে ক্রমবর্ধমান দূষণ ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। এসব কিছুর জন্যই দায়ী করা হচ্ছে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবকে। গ্রাম ও নগরাঞ্চলের এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরাই এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পথেও এখন সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে শিক্ষার অভাবকে।
এনআইসিআরএইচের ২০০৫-১৭ সাল পর্যন্ত শনাক্তকৃত ক্যান্সার রোগীদের তিন-চতুর্থাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ হার এখন প্রায় ৮৪ শতাংশ। ২০০৫ সালেও তা ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ।
দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের বড় একটি অংশ গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক। যথোপযুক্ত শিক্ষা না থাকায় সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) ও গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই তাদের। তাদের মধ্যে কীটনাশকসহ কৃষি রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি। আবার এসবের প্রয়োগ হচ্ছে কোনো ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা উপকরণ ছাড়াই। দেহে প্রবেশ করছে রাসায়নিক ও কীটনাশকের মারাত্মক ও ক্ষতিকর সূক্ষ্ম উপাদান। হয়ে উঠছে মরণব্যাধির কারণ। একই সঙ্গে কমিয়ে দিচ্ছে দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও।
২০১৭ সালে এনআইসিআরএইচে ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয় ১৪ হাজার ৪৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ কৃষক। ২০১৫ সালে হাসপাতালটিতে শনাক্তকৃতদের মধ্যে কৃষক ৩০ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ।
শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবকেই অর্থনৈতিকভাবে নাজুক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে দেখছেন এনআইসিআরএইচের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির বিষয়টি এরই মধ্যে সামনে এসেছে। কৃষিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারকে এর বড় একটি কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর জীবনাচারও শহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রদের মধ্যে রোগটির প্রকোপ বাড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে ধূমপান, গুল ও পান ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা ও অসচেতনতার কারণে দেশের ক্যান্সার আক্রান্তদের বড় একটি অংশকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যানও বলছে, শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশকেই এ সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। যদিও দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অবহেলা দেখা যায়। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের কোনো শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করতে সময় লাগছে বেশি। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই শিশুদের সময়মতো চিকিৎসা করাতে পারে না। বিষয়টিকে আরো বিলম্বিত করে তোলে দুর্বল সরকারি ও স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। দেশে এরই মধ্যে শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছে ক্যান্সার। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও তা উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিশুমৃত্যুর এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি হচ্ছে শৈশবকালীন ক্যান্সারে। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর ৯-১২ হাজার শিশু-কিশোর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষা ও সচেতনতা—দুটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষায় ঘাটতি থাকলে ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়ে সচেতনতা থাকে না। কোনো ব্যক্তির শিক্ষা বা সচেতনতার ঘাটতি থাকলে শারীরিক অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়ার পর সে চিকিৎসকের কাছে আসে না। সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা ক্যান্সারের কারণ, প্রতিরোধ ও সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে পারি। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই কাজে লাগানো যায়। জনগণকে ক্যান্সার সম্পর্কে ধারণা দেয়া গেলে তাদের সার্বিকভাবে ক্যান্সার চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব।
ক্যান্সার আক্রান্তদের বড় একটি অংশ পেশায় দিনমজুর। এনআইসিআরএইচে ২০১৭ সালে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে দেড় শতাংশ ছিলেন দিনমজুর। এর আগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ৬ ও ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সারা দেশের শনাক্তকৃত-অশনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে এ হার আরো বেশি হতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দারিদ্র্য ও ক্যান্সার সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার পর সময়মতো চিকিৎসকের কাছে আসে না। জীবিকার জন্য নানা ধরনের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই পরিবেশের দূষিত পদার্থগুলোর কাছাকাছি আসতে হয় তাদের। খাদ্যাভ্যাসও অস্বাস্থ্যকর।
দেশে বিধবাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকটাই নাজুক। তাদের মধ্যেও এখন ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে বেশি। এনআইসিআরএইচে ২০১৭ সালে শনাক্তকৃতদের ১ দশমিক ৭ শতাংশ ছিলেন বিধবা নারী। আগের বছর এ হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসা সুবিধাও অপ্রতুল। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে রোগটি নিয়ে জাতীয় কোনো পরিসংখ্যানও নেই। ক্যান্সার চিকিৎসায় একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এনআইসিআরএইচ। দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত তিন বছরে হাসপাতালটিতে ৭৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছিল। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের মধ্যে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ বলে ধারণা করছেন এনআইসিআরএইচ-সংশ্লিষ্টরা।
এর মধ্যে শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসায় অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বড়দের ক্যান্সার চিকিৎসায় কিছু সুযোগ-সুবিধা দেখা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই যৎসামান্য। এক্ষেত্রে রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে দেখা হচ্ছে বড় একটি সমস্যা হিসেবে। রয়েছে শয্যা, যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের অভাবও। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়া শিশুর ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও সংকট রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আগে রোগ নির্ণয়ের সুবিধাগুলো কম ছিল। এখন সুযোগ বাড়ায় আমরা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারছি। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেও ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করা যাচ্ছে। সরকার সারা দেশের আট বিভাগের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় প্রায় ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিট বাস্তবায়ন করছে। চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি আমরা ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোরও চেষ্টা করছি। তামাক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ক্যান্সারের কারণগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াস চলমান রয়েছে।