দেশে সরকারি প্রতিটি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সব ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সংবলিত নিজস্ব একটি হাসপাতাল থাকার কথা। টারশিয়ারি পর্যায়ের এসব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের অধীনে জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবায় হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া। যদিও এখন পর্যন্ত দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর প্রায় অর্ধেকেরই নিজস্ব হাসপাতাল গড়ে তোলা যায়নি। স্থানীয় জেলা ও জেনারেল হাসপাতালগুলোয় প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করছেন এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
দেশে তিন পর্যায়ের হাসপাতালের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের ধরা হয় উপজেলা পর্যায়ের ও এর চেয়ে ছোট পরিসরের হাসপাতালগুলোকে। মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতাল ধরা হয় জেলা (১০০-২০০ শয্যাবিশিষ্ট) ও জেনারেল হাসপাতালগুলোকে (২৫০ শয্যাবিশিষ্ট)। কমপক্ষে পাঁচশ শয্যার হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট হাসপাতালগুলোকে বলা হয় তৃতীয় বা টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষায়িত ও জটিল রোগের চিকিৎসা হয় প্রধানত টারশিয়ারি পর্যায়ের বড় হাসপাতালগুলোয়। এসব হাসপাতালে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে ছাত্রাবস্থায়ই বিশেষায়িত ও জটিল রোগের চিকিৎসা-সংক্রান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে নিজস্ব হাসপাতালের অভাবে যেসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী জেলা ও জেনারেল হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেন, তাদের এ অভিজ্ঞতায় কিছুটা হলেও ঘাটতি থেকে যায়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৭টি। এসব মেডিকেল কলেজের মধ্যে নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে ১৯টির। এর মধ্যে পূর্ণরূপে চালু রয়েছে ১৮টি। সম্প্রতি পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালকে পাঁচশ শয্যায় উন্নীত করে স্থানীয় মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত করে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। বাকি ১৮টির শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন স্থানীয় জেলা ও জেনারেল হাসপাতালে। এর মধ্যে ছয়টির জন্য বর্তমানে হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে। অন্য ১২টির কোনো কোনোটিতে এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত হয়নি।
বর্তমানে ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, গোপালগঞ্জে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের নির্মাণাধীন হাসপাতালের বহির্বিভাগ এরই মধ্যে চালু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কোনো রোগী ভর্তি করা যায়নি। হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে এমন আরেকটি মেডিকেল কলেজ হলো সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ। সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করা মেডিকেল কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য সরকারের প্রণয়নকৃত নীতিমালা থাকলেও সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসব কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে বিএমডিসির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতিটি মেডিকেল কলেজের অবশ্যই নিজস্ব হাসপাতাল থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কলেজের সঙ্গে একই জমিতে ভিন্ন ভবনে হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের শয্যা সংখ্যাসহ কলেজে কোন বিভাগের কতজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী থাকবে তা-ও নির্দেশিকায় উল্লেখ করা রয়েছে।
এ নির্দেশিকা অনুযায়ী সরকারি যেসব মেডিকেল কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল গড়ে তোলা যায়নি, বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেগুলোর শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হচ্ছেন। প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে তারা সরকারি অন্য মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সমান দক্ষতা নিয়ে চিকিৎসাসেবায় আসতে পারছেন না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার মতো নয়। এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একই মানের হতে হবে। মানুষের সুস্থতার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় সেবা একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছে পাওয়া যাবে। যেসব কলেজের হাসপাতাল নেই, সেসব কলেজের শিক্ষার্থীরা জেলা বা জেনারেল হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এসব শিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণ পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। কারণ জেলা বা জেনারেল হাসপাতালে খুবই সাধারণ চিকিৎসা হয়। দেশের চিকিৎসকদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য রাখা যাবে না। দেশের প্রথম দিককার একটি কলেজ থেকে যে শিক্ষার্থী চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছেন, তার সঙ্গে নতুন কলেজের চিকিৎসকের বড় রকমের পার্থক্য দেখা যায়। এটি ঘটছে মূলত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে। সার্বিক চিকিৎসাসেবায়ই এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। এজন্য খাতসংশ্লিষ্টরা যা কিছুই বলুক না কেন, জেনারেল হাসপাতালে যে প্র্যাকটিস হচ্ছে তাতে অপূর্ণতা থাকবেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. আরমান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, একই প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়ার পর নির্দিষ্ট শর্তপূরণ সাপেক্ষে চিকিৎসকদের নিবন্ধন দেয়া হয়। সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য নিজস্ব হাসপাতাল না থাকলে তা সরকারের বিষয়। সেটি নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না। তবে বিশেষায়িত না হলেও এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্তত জেনারেল হাসপাতালে প্র্যাকটিস করে আসেন।
বর্তমানে পাবনা মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী আব্দুল মালেক মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ ও চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকল্প প্রস্তাবে রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটির বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।
নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় এক যুগ আগে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে। এর পর থেকে কলেজটিতে এ পর্যন্ত মোট ১৩টি ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর নিজস্ব হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। তবে এগোয়নি নির্মাণকাজ। কলেজের শিক্ষার্থীরা ১০ কিলোমিটার দূরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুছ ছালাম বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর কোনোটিতে এক শতাধিক বিভাগ রয়েছে। আমাদের কলেজে ১১টি মৌলিক বিভাগসহ প্রায় ২৫টি বিভাগে এক শতাধিক শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবেই শিক্ষা লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড (সংযুক্তি) কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নে পরীক্ষা হয়। আর বিএমডিসি প্রণীত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজে পড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রাখার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে নিজস্ব হাসপাতাল না থাকায় হাতে-কলমে শিক্ষার অপূর্ণতার বিষয়টি আপেক্ষিক বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সব মেডিকেল কলেজে নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে তৃতীয় বর্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল প্রাকটিসে যায়। যেসব কলেজের হাসপাতাল নেই, সেগুলোকে স্থানীয় জেনারেল হাসপাতালে যুক্ত করা হয়েছে। এর কোনোটিই ২৫০ শয্যার নিচে নয়। কোর্সে যতটুকু ক্লিনিক্যাল বিষয় রয়েছে, তা জেনারেল হাসপাতালে থাকে। এরপর যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অপূর্ণ বলা হয়, তা আপেক্ষিক। কেননা এর শেষ নেই। যেসব কলেজের হাসপাতাল নেই, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির জন্য প্রকল্প প্রস্তাব এরই মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা)