খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ: ভিন্ন এলাকায় কলেজের হাসপাতাল

দেশে সরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অনুপাতে দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু আইনে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত না মেনেই বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে শিক্ষা কার্যক্রমে ঘাটতি থাকায় এসব মেডিকেল কলেজ থেকে মানহীন চিকিৎসক তৈরি হচ্ছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মেডিকেল কলেজগুলোই মূলত নিয়ম না মানায় এগিয়ে রয়েছে। তেমনই একটি মেডিকেল কলেজ খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ। একই জমিতে ভিন্ন ভবনে কলেজ ও হাসপাতাল থাকার বিষয়টি আইনানুগভাবে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত থাকলেও সেটি মানেনি কর্তৃপক্ষ। কলেজ ও হাসপাতালের অবস্থান ভিন্ন এলাকায়। আর দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার।

অবকাঠামোগত ঘাটতি, শিক্ষকের সংকট, গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার, শ্রেণীকক্ষসহ বিভিন্ন বিষয়ে শর্ত পূরণ না করেই চলছে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। একইভাবে খুলনা মহানগরীতে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ আইনে উল্লেখিত জমি ও ভবন নির্মাণের শর্ত পূরণ করেনি। এতে কলেজের হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের শিখন ও স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম অনুমোদন পায় ২০১৩ সালের নভেম্বরে। সে সময় ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য ৫০ জন শিক্ষার্থীকে ব্যাচেলব অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রিতে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে বেসরকারি এ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পৌনে তিনশ শিক্ষার্থী রয়েছেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন ২০২২ কার্যকর করে সরকার। আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। আইন কার্যকর হওয়ার আগেও নীতিমালা মানেনি খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ।

আইনের ‘৬’ ধারার ‘গ’ উপধারায় ‘অখণ্ড’ জমির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ধারার ‘ছ’ উপধারায় কলেজ ও হাসপাতালের জন্য পৃথক ভবনের কথা বলা আছে। খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ ও কলেজের হাসপাতালের জন্য পৃথক ভবন থাকলেও তা অখণ্ড জমিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। কলেজের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছয় হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেসের ঘাটতি রয়েছে। ৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে রোগীদের জন্য ২৫০ শয্যা থাকার কথা থাকলেও আছে ১৮৬টি।

সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনা মহানগরীর রয়েল মোড়ে সংযুক্ত একটি চারতলা ভবনে কলেজের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর হাসপাতালের অবস্থান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ময়লাপোতা এলাকায়। কয়েক বছর আগে নির্মিত ১৫তলা এ হাসপাতাল ভবনটিতে কলেজের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাবিদ্যায় হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেন। পৌনে দুই লাখ ফ্লোরস্পেসের হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শয্যার ঘাটতি রয়েছে। আবার ভিন্ন এলাকায় ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসের অবস্থান। ছাত্রদের জন্য ৫০ শয্যা এবং ছাত্রীদের জন্য ১০০ শয্যার আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন অনুযায়ী গঠিত কমিটি কলেজগুলোকে পরিদর্শন শেষে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম অনুমোদনের সুপারিশ করে। সাধারণত প্রতি বছর পরিদর্শন করে কলেজের মূল্যায়ন প্রতিবেদন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে পাঠানো হয়। খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে কমিটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীতিমালা (২০২২ সালে আইন কার্যকর করার আগে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করার বিধান রয়েছে) অনুযায়ী বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করেনি খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে যেসব শর্ত মানতে হয় তা মেনে বাংলাদেশে কলেজ খুলতে দেখা যায় না। মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) প্রয়োজনীয় আইন বা নীতিমালার বাস্তবায়ন দেখবে। এ তিন কর্তৃপক্ষ যদি আইন অনুযায়ী কাজ করে, তবে কোনো মেডিকেল কলেজ অসম্পন্ন ও ঘাটতি রেখে একাডেমিক ও হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। সরকারের তিনটি কর্তৃপক্ষের নীতিমালাগুলো মানতে বাধ্য করতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষার বিষয়ে আপস করলে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবার মান হবে সর্বনিম্ন।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের পরামর্শ অনুযায়ী, একটা নির্দিষ্ট স্থানেই একটা মেডিকেল কলেজ হবে। এই কলেজের সবকিছুই হতে হবে একই ক্যাম্পাসে। এতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সুবিধা হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কলেজে সরকারের আইন বা নীতিমালা অনুযায়ী যতটা জায়গা থাকার দরকার সেটা নেই। অদূর ভবিষ্যতে ওই আইন মেনে যে মেডিকেল কলেজ করতে হবে তেমনটা সরকারও নির্দিষ্ট করে দেয় না বা দিলেও সেটা মানা হয় না। এমন চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সরকার মোটামুটি দেখেও দেখছে না। ফলে তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ২০২২ সালের অক্টোবরের সর্বশেষ খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করে। ওই প্রতিবেদন এবং ২০২১ সালের পরিদর্শন প্রতিবেদনে কলেজ ও হাসপাতাল ভবন যে অভিন্ন জমিতে তা গোপন করা হয়েছে। হাসপাতাল ও কলেজ ভবন একই ক্যাম্পাসে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন তৈরিতে গাফিলতি রয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান।

আইন না মেনে ভিন্ন এলাকায় কলেজ ও হাসপাতাল ভবন স্থাপন করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু আসফার কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এমএ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কলেজ রয়েল মোড়ে আর হাসপাতাল ময়লাপোতা মোড়ে। আমাদের কলেজ সরিয়ে আনা হবে। হাসপাতালের পাশে কলেজ ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।’

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কলেজ থেকে হাসপাতাল দূরে হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ ও চিকিৎসাসেবায় অংশ নেয়ার বিষয়ে কিছুটা ঘাটতি থাকে। আমরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। তারা আইনের শর্তগুলো মানছে কিনা সে বিষয়ে কাজ করছি। আরো দুই কর্তৃপক্ষ মেডিকেল কলেজগুলোকে দেখভাল করে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো যখন যাত্রা করে তখন তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। পরে বারবার বিষয়গুলো তাদের নজরে এনে সংশোধনের সুযোগ দিই। এর পরও কোনো প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ না করলে বন্ধ করে দেয়া হয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: