বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাছের ঘের। মাঝখানে মৃতপ্রায় একটি খালের পাড়ে ছোট একটি গ্রাম ময়নাপুর। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা ৪৪। গত চার বছরে গ্রামটিতে শিশুর জন্ম হয়েছে মোটে সাতজনের। এর মধ্যে গত এক বছরে জন্ম হয়েছে মাত্র একটি শিশুর।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটি। স্থানীয়দের আয়ের উৎস মাছের ঘের বা দিনমজুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাটিতে ফলদ কোনো গাছ নেই। নিম্ন আয়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের ফল কিনে খাওয়ারও সক্ষমতা নেই। প্রতি বছর সামান্য কিছু মৌসুমি ফল কিনে খেতে পারেন তারা। নিজ ঘেরের মাছ, ভাত, ডাল ও বাড়ির আনাচ-কানাচ থেকে সংগৃহীত শাকসবজিই তাদের প্রধান খাদ্য।
ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধামালিয়া ইউনিয়নের মধ্যে এ গ্রামটিতেই ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। প্রায় প্রতি বছরই গ্রামের জলাধার ও মাছের ঘেরে নোনাপানি প্রবেশ করে। স্থানীয় বাসিন্দা, ধামালিয়া ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জলাবদ্ধতা, আর্থিক অনটনের কারণে বেশকিছু পরিবার গ্রাম থেকে অন্যত্র চলে গেছে। ফলে শিশুদের সংখ্যাও কমেছে। গত চার বছরে পুরো গ্রামে মাত্র সাতটি শিশুর জন্ম হয়েছে। এছাড়া পরিবারগুলোয় প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের মধ্যে বয়সের ব্যবধান আট থেকে ১২ বছরও দেখা যায়।
প্রজনন হারের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে মারাত্মক অপুষ্টি ও দারিদ্র্যপ্রবণ গ্রামটি। ডুমুরিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, খুলনা জেলায় মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ১ দশমিক ৯। ময়নাপুর গ্রামে টিএফআর দশমিক ২৪।
স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামটির বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পুষ্টিহীনতাও প্রকট। প্রায়ই নানা দুর্যোগের শিকার হচ্ছে গ্রামটি। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি পরিবার গ্রাম থেকে স্থানান্তরিতও হয়েছে। যারা একটু লেখাপড়া শিখছে, তারাও গ্রামে থাকতে আগ্রহী নয়। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যেও সন্তান গ্রহণে এক প্রকার অনীহা দেখা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো এখন দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এসব এলাকার দরিদ্র বাসিন্দারাই এখন সবচেয়ে বেশি নাজুক পরিস্থিতিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা স্থানীয় জনসাধারণের প্রজনন আচরণে প্রভাব ফেলে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তায় এর বিরূপ প্রভাবে প্রজনন হার কমে যাওয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণাও হয়েছে।
ময়নাপুর গ্রামের শুরুর বাড়িটি উত্তম মণ্ডলের। বয়স পঁয়তাল্লিশের বেশি। ঘরের বারান্দায় হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান দিয়েছেন তিনি। তিনি জানালেন, গ্রামের বাসিন্দাদের প্রায় সবাই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। তবে বিচ্ছিন্ন গ্রাম হওয়ায় দূরের এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হয়। নিজস্ব জমিতে ধান ও সবজি চাষ করলেও তাতে পরিবারের প্রয়োজন মেটে না। গ্রামের কারো কারো মাছের ঘের থাকলেও তা আকারে খুবই ছোট। ঘেরের মাছ বিক্রির টাকায়ও চলে না সংসার। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি পরিবার গ্রাম থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। এতে গ্রাম আরো সংকটের মধ্যে পড়েছে।
ময়নাপুরের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে বলে জানালেন খুলনা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল আজিম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে টিএফআর দুইয়ের ওপরে থাকলেও তা কোনো কোনো স্থানে প্রায় তিনের কাছাকাছি আবার কোনো কোনো এলাকায় একের কম। ময়নাপুরের চিত্র দিয়ে পুরো জেলার প্রজনন হার ব্যাখ্যা করা যাবে না। তবে আমরা অবশ্যই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখব।
গ্রামে একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর অভাবে এখন বন্ধ হতে বসেছে। ২০৩ নং ময়নাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানী জানান, ১৯৯০ সালে কমিউনিটি স্কুল হিসেবে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পায়। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে একজন মাত্র ছাত্র রয়েছে। এ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। আরো দুজন পাঁচ বছর বয়সী শিশু থাকলেও জন্ম নিবন্ধন না থাকায় তাদের ভর্তি করা যায়নি।
ডুমুরিয়ার ধামালিয়া ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কর্মী ও স্থানীয়রা জানান, গ্রামটিতে সর্বশেষ গত বছর শুধু একটি কন্যাশিশুর জন্ম হয়েছিল। ১৮ বছর আগেও গ্রামটিতে শিশুদের এমন সংকট তৈরি হয়েছিল। চলতি বছর যে কয় দম্পতি বিয়ে করেছে, তাদের সন্তান জন্ম না নিলে আগামী বছরও নবজাতকশূন্য থাকবে গ্রামটি।
খালের ওপারে রয়েছে যশোরের কেশবপুর উপজেলার আরেকটি গ্রাম। ওই গ্রামেরও নাম ময়নাপুর। ৫৩ পরিবারের এ গ্রামেও একই নামে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে সেখানে ১৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। দুই স্কুলের দূরত্ব প্রায় ২০০ গজ। সে গ্রামের অবস্থাও প্রায় একই রকম।
ময়নাপুরের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালানো উচিত বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণভাবে দারিদ্র্যের সঙ্গে অধিক সন্তান জন্ম দেয়ার একটি সম্পর্ক আমাদের সমাজে দেখতে পাই। তবে ময়নাপুরের পরিস্থিতি ভিন্ন। গ্রামটি যে ১৫-২০ বছর পরপর শিশু সংকটে পড়ছে, তাতে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। এতে প্রজন্মের মধ্যে বড় ব্যবধান থেকে যায়।