গৃহস্থালির বায়ুদূষণ: প্রারম্ভিক শৈশবের বিকাশ বিলম্বিত হচ্ছে ২৫% শিশুর

দেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িতেই রান্নার কাজে কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। ফলে দূষিত হয়ে পড়ে গৃহস্থালির বায়ু। এ দূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের স্বাস্থ্যে। বিলম্বিত হচ্ছে দেড় থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রারম্ভিক শৈশবের বিকাশ। এর ভুক্তভোগী হচ্ছে ২৫ শতাংশ শিশু। সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে, গৃহস্থালির দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। শৈশবের শুরুতেই বিকাশ বিলম্বিত হওয়ার এ প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক জার্নাল অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অ্যাসোসিয়েশন বিটুইন হাউজহোল্ড এয়ার পলিউশন অ্যান্ড আর্লি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যামং চিলড্রেন এইজড ৩৬-৫৯ মানথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি গবেষণা সংস্থার মোট ছয়জন গবেষক। দেড় থেকে পাঁচ বছর বয়সী প্রায় সাড়ে নয় হাজার শিশুর তথ্য নিয়ে গবেষণাটি তৈরি করা হয়েছে।

গবেষণা বলছে, দেশে রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের ব্যবহার হচ্ছে ১৯ শতাংশ ও ঐতিহ্যগত কঠিন জ্বালানি যেমন কাঠ, পাতা, খড়, শুকনো গোবরের ব্যবহার হচ্ছে ৮১ শতাংশ পরিবারে। বসবাসের ঘরের মধ্যেই রান্নার কাজ করছে ৩৪ শতাংশ পরিবার। একই ঘরের মধ্যে ভিন্ন কক্ষে ৩৭ শতাংশ ও ঘরের বাইরে ভিন্ন স্থানে রান্না করছে ২৮ শতাংশ পরিবার।

মূলত চারটি পরিমাপকে শিশুদের প্রারম্ভিক শৈশবের বিকাশ পরিমাপ করা হয়। এগুলো হচ্ছে সংখ্যা ও বর্ণ পরিচয় সক্ষমতা, শারীরিক বৃদ্ধি, সামাজিক আবেগজনিত বিকাশ ও শিখন-জ্ঞান বিকাশ। গবেষকরা বলছেন, সংখ্যা-বর্ণপরিচয়ের সক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রতিটি শিশুকে ১০টি অক্ষর শনাক্ত করতে দেয়া হয়। এতে যারা কমপক্ষে চারটি সহজ শব্দ পড়তে ও চিনতে পেরেছে তার বিকাশ স্বাভাবিক ধরে নেয়া হয়। শারীরিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি শিশু যদি দুটি আঙুল দিয়ে একটি ছোট বস্তু তুলতে পারে এবং যদি তার পরিচর্যাকারী অসুস্থতার ইঙ্গিত না দেয়, তাহলে তার শারীরিক বিকাশ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সামাজিক আবেগজনিত ক্ষেত্রে শিশু মিশতে গিয়ে অন্য শিশুদের আঘাত না করলে ও সহজে বিভ্রান্ত না হলে স্বাভাবিক বিকাশ হয়েছে ধরা হয়। সর্বশেষ শিখন-জ্ঞানের ক্ষেত্রে নির্দেশনা অনুযায়ী শিশুর কাজ করার সক্ষমতাকে বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়েছে।

গৃহস্থালির বায়ুদূষণ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এতে শ্বাসযন্ত্রের রোগের পাশাপাশি শিশুমৃত্যু, কম ওজন, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের আশঙ্কা তৈরি হয়। ক্ষতির শিকার হয় গর্ভে থাকা শিশুও। বায়ুতে নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন থাকলে তা জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে।

গবেষণার তথ্য বলছে, গৃহস্থালির বায়ুদূষণের কারণে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুর প্রাথমিক শৈশবের বিকাশ বিলম্বিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৭১ শতাংশ শিশু সংখ্যা ও বর্ণ পরিচয়ে অক্ষম, ২৭ শতাংশ শিশুর সামাজিক আবেগজনিত বিকাশ হয়নি, ৯ শতাংশ শিশুর শিখন-জ্ঞান ও ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ হয়নি। গ্রামাঞ্চলে ২৬ শতাংশ শিশুর প্রারম্ভিক শৈশব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আর শহরাঞ্চলের তা ২২ শতাংশ। বিকাশ বিলম্বিত হওয়া শিশুদের হার সর্বোচ্চ ময়মনসিংহে। এ বিভাগের ৩৯ শতাংশ শিশুর বিকাশ বিলম্বিত। ৩৮ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট।

গবেষণাটির প্রধান গবেষক জুয়েল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, জীবনের শুরুতেই শৈশবের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি দুই বছর বয়সের পর পরিমাপ করা যায়। গৃহস্থালির বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। কেননা তারা বাড়িতেই থাকছেন বেশি। বেশির ভাগ পরিবারে আলাদা রান্নার ঘর নেই। শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েরা গৃহস্থালির কাজ করেন।

বায়ুদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুুস সালাম। তার মতে, বায়ুদূষণের সঙ্গে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও শিখন সক্ষমতা জড়িত। বাইরে থেকে আসা দূষণের পাশাপাশি ঘরের বায়ুদূষণ শিশুদের অসুস্থ করে তুলছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজির সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, কোনো শিশুকে যদি পুষ্টিকর প্রয়োজনীয় খাবার দেয়া হয় কিন্তু সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা না যায়, তাতে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। শৈশবে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে তা পরবর্তী জীবনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: