গ্যাস বাঁচাতে পানি না ফোটানোর প্রবণতা: রাজধানীতে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী

মিরপুরের বাসিন্দা আবু তারিফ। মিটারযুক্ত পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে রান্না চলে তার বাসায়। তবে কয়েক মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসারের খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন তিনি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের খরচ বাঁচিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয় সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন তিনি। আর তা করতে গিয়ে সম্প্রতি দু-একদিন পানি না ফুটিয়ে পান করেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। এতে পেটে পীড়া অনুভব হলে বুঝতে পারেন পানি বিশুদ্ধ হয়নি। ফলে আবারো পানি ফুটিয়ে পান করতে শুরু করেছেন। তবে আবু তারিফ ফুটিয়ে পানি পান করলেও রাজধানী ও আশপাশ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই তা করছে না। বিশেষ করে যারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা আরো বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব।

গরমের মৌসুম শুরু না হতেই সারা দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা গেছে। বিশেষ করে রাজধানীতে প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মহাখালীর হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। মাত্র ১০ দিনে হাসপাতালটিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের ভর্তি সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পেটের পীড়া নিয়ে ভর্তি হচ্ছে এসব রোগী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা, শনির আখড়া, মানিকনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কড়াইল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ঢাকার বাইরের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকেও রোগী আসছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসার জন্য আসছে শতাধিক রোগী। হাসপাতালটিতে গত এক সপ্তাহে প্রায় এক হাজার রোগী ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছে। বেশির ভাগ রোগী আসছে নগরীর পাইকপাড়া, জলারপাড়, বাবুরাইল, নিতাইগঞ্জ, নয়াবাজারসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকা থেকে।

গতকাল মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে গিয়ে রোগীর ভিড় দেখা যায়। রোগীর চাপ সামলাতে অস্থায়ী তাঁবুর ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখানে কেবল গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৯২৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহের সোমবার ১ হাজার ২১৬, মঙ্গলবার ১ হাজার ২৭২, বুধবার ১ হাজার ২৩৩, বৃহস্পতিবার ১ হাজার ১৭৬, শুক্রবার ১ হাজার ১৩৮ জন রোগী ভর্তি হয়। এরপর শনিবার ১ হাজার ২৪৫, রোববার ১ হাজার ২৩০, সোমবার ১ হাজার ৩৩৪ ও মঙ্গলবার ১ হাজার ৩৩৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে ১০ দিনে ভর্তি হয়েছে ১১ হাজারের বেশি রোগী। গড়ে দৈনিক ১ হাজার ২০০ রোগী চিকিৎসার জন্য এসেছে হাসপাতালটিতে।

অনিরাপদ পানি পানের ফলে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজধানীতে বেশির ভাগ এলাকার পানিই ফুটিয়ে পান করতে হয়। ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তা শতভাগ নিরাপদ নয়। ফলে এ পানি ফিল্টার করে অথবা ফুটিয়ে পান করার বিকল্প নেই। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সিলিন্ডার গ্যাসে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা দেখা গেছে।

জানা যায়, দেশে গ্যাস সংকটের কারণে ২০০৯ সালে সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবারো আবাসিকের সংযোগ চালু হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে জ্বালানি বিভাগ থেকে অলিখিতভাবে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন গ্রহণে নিষেধ করে দেয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। ফলে ২০১৪ সালের পর থেকে রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেসব নতুন ভবন নির্মাণ হয়েছে, সেগুলোয় নেই গ্যাস সংযোগ। এসব ভবনের বাসিন্দারা মূলত সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

সিলিন্ডার গ্যাসের দাম দাম বাড়ায় এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে পানি ফোটানোর ক্ষেত্রে বহু পরিবারে অনীহা থাকতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যেভাবেই হোক মানুষ হঠাৎ করে বিশুদ্ধ পানি পান করছে না। ফলে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। মানুষ ঘরের বাইরে যাচ্ছে। এ সময় রাস্তায় প্রস্তুত বিভিন্ন ধরনের শরবত খাচ্ছে, যা কোনো উপায়েই বিশুদ্ধ করা হয়নি। পানি ফুটানো না গেলে হ্যালোজেন ট্যাবলেট দিয়ে বিশুদ্ধ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ফিটকিরি (সোডিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামের একটি যৌগ লবণ) ও ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে বিশুদ্ধ করা সম্ভব।

আইসিডিডিআর,বি বলছে, প্রতি বছর সাধারণত শীত শুরু ও গরম মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে এর আগে কখনই দৈনিক এত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। দেশে এখন নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমেছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের বাইরের খাবার ও পানীয় গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। এক্ষেত্রে অসতর্কতার কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে পারে। এবার হাসপাতালে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর ভিড় বেশি বলেও জানা গেছে।

আইসিডিডিআর,বির সহকারী বিজ্ঞানী শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, প্রতি বছর অন্তত দুবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। তবে এ বছর রোগীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে মানুষ অসাবধানতাবশত বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছে। সম্প্রতি স্কুল-কলেজ খুলে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এখন বেশির ভাগ রোগী আসছে মারাত্মক পানিশূন্যতা নিয়ে। এ কারণে হাসপাতালে আনার আগে অবশ্যই রোগীর পানিশূন্যতা দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া যেকোনো উপায়ে বাইরের খাবারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরামর্শ দেন এ গবেষক। তিনি জানান, কয়েক দিন ধরে ডায়রিয়া দেখা দেয়ার পর থেকে রাজধানীতে মহাখালীর বিশেষায়িত এ হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও শিশু হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। অনেক হাসপাতালেই রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছে বলেও জানা গেছে।

আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম বণিক বার্তাকে জানান, বর্তমানে যেসব রোগী আসছেন তারা চরম মাত্রার পানিশূন্যতায় ভুগছে। আমরা রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পানিশূন্যতা পূরণ করার ব্যবস্থা নেই। কিছু সময় দেরি হলেই দেখা যায়, রোগীর জীবন বাঁচানো কষ্টের হয়ে যায়। যারাই আসছে তাদের পানীয়জল বিশুদ্ধ ছিল না বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬০-৭০ শতাংশ রোগীই প্রাপ্তবয়স্ক। মধ্যবয়স্ক, যুবক ও বৃদ্ধদের পাওয়া যাচ্ছে বেশি।

এ চিকিৎসক জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞা অনুযায়ী ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতা, মধ্যম বা পার্সিয়াল পানিশূন্যতা ও পানিশূন্যতা নেই এমন হতে পারে। তবে আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে যারা আসছে, সবাই তীব্র পানিশূন্যতায় ভুগছে।

এর আগে আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে সময় দৈনিক এক হাজারের কিছু বেশি রোগী ভর্তি হলেও এখন তা ১ হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। এরই সঙ্গে বর্তমানে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত।

Source: Bonik Barta

Share the Post: