গ্রামাঞ্চলে প্রসূতি নারীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ: তীব্র গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়লেও কমেছে প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ

শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতায় প্রভাব ফেলেছে চলমান অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ। ঝুঁকি বাড়ছে গর্ভবতী মা ও অনাগত সন্তানের। এর মধ্যেই প্রসবপূর্ব সেবা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার (এএনসি) গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছেন গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী নারীরা। গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানভেদে এএনসি গ্রহণের হার কমেছে ১০-২০ শতাংশ। কোথাও কোথাও তা ২৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে প্রসবপূর্ব সেবা নিতে না যাওয়ার প্রবণতা গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যেই বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের তাপমাত্রা গর্ভবতী নারীর শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি বা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর পৌঁছলে রক্তের ভারসাম্যহীন প্রবাহ গর্ভের শিশুর পুষ্টি ও অক্সিজেনে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন), হরমোন পরিবর্তনের (প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ও অক্সিটোসিন) ভারসাম্যহীনতা অকালে প্রসবের সম্ভাব্য সূত্রপাত ঘটায়। গর্ভবতী নারীদের ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা থাকে।

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও রেসিডেনশিয়াল সার্জন ডা. ছাবিকুন নাহার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে অন্যদের চেয়ে গর্ভবতীরা বেশি সমস্যায় পড়েন। এ সময় গর্ভবতীরা হরমোনাল ইমব্যালেন্সে থাকেন। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে। অজ্ঞান হওয়া কিংবা অস্থির হয়ে পড়তে পারেন গর্ভবতীরা। ফলে আমরা গর্ভবতীদের এ সময় খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে বলি।’

গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রসূতিকে কমপক্ষে চারবার চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা বাদে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ সেবা দিয়ে থাকে।

দেশে গত মার্চ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত গর্ভবর্তী নারীর সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৬০ হাজার। বিভাগভিত্তিক হিসাবে রাজশাহীতে ১ লাখ ৯ হাজার, খুলনায় ১ লাখ ২ হাজার, বরিশালে ৫৫ হাজার, ঢাকায় ২ লাখ ৯ হাজার, চট্টগ্রামে ২ লাখ ২০ হাজার, সিলেটে ৮০ হাজার, রংপুরে ১ লাখ ৬ হাজার এবং ময়মনসিংহে ৭৭ হাজার গর্ভবতী রয়েছেন। ওই পরিসংখ্যানের বাইরে সারা দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেবা প্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী প্রসবপূর্ব সেবা নিচ্ছেন।

দেশে অন্তত পাঁচটি জেলার সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাপপ্রবাহের কারণে এএনসি গ্রহণের হার কমেছে। তাপপ্রবাহ আরো দুই সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে সেবা গ্রহণের হার তলানিতে পৌঁছার আশঙ্কা রয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে শুধু পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বর্তমানে ১২ হাজারের বেশি প্রসূতি প্রসবপূর্ব সেবা নিচ্ছেন। জেলা সদরের চর শাহী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গত ফেব্রুয়ারিতে ১২৬ জন প্রসূতি এএনসি সেবা নিয়েছেন। মার্চে সেবা নিতে এসেছিলেন ১০৭ জন। ১৮-২১ এপ্রিলের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কেন্দ্রটিতে তিনদিনে ১৩ গর্ভবতী এএনসি সেবা নিতে এসেছিলেন।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) প্রসবপূর্ব সেবা বা এএনসির সংজ্ঞায় বলেছে, প্রসবপূর্ব সেবা প্রসূতিদের প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে এবং গর্ভাবস্থা ও প্রসবের সময়ের করণীয় বুঝতে সহায়তা করে। প্রতিরোধমূলক এ স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে নারীর গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর আচরণ সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতনতা সৃষ্টি করেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারবার স্যাটেলাইট ক্লিনিক, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা বা জেনারেল হাসপাতালে এসে শারীরিক পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথম সেবা গর্ভধারণের চার মাস বা ১৬ সপ্তাহের মধ্যে নিতে হবে। ২৪-২৮ সপ্তাহে দ্বিতীয় সেবা, ৩২ সপ্তাহে তৃতীয় সেবা এবং চতুর্থ সেবার সময় হলো গর্ভ ধারণের ৩৬ সপ্তাহে। সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে চার-আট মাসের মধ্যে দুই ডোজের টিটি টিকা, খাদ্য তালিকার পরামর্শ, দৈনন্দিন কাজের পরামর্শ, ঘুম-বিশ্রাম ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ। এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন।

পঞ্চগড় জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে ৩৮টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং দুটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে সোয়া সাত হাজার গর্ভবতী সেবা নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত রমজান মাসে এএনসি সেবা নিতে কেন্দ্রে আসা গর্ভবতীদের সংখ্যা কম থাকে। ধান কাটার মৌসুম থাকলেও সেবা নেয়ার হারে প্রভাব পড়ে। এর সঙ্গে চলমান তাপপ্রবাহ সেবা গ্রহণের হার কমিয়েছে। সেবা গ্রহণের হার ২০-২৫ শতাংশ কম হতে পারে বলে ধারণা তাদের।

পঞ্চগড় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু তাহের মো. সানাউল্লাহ নুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঈদ, ফসল তোলার মৌসুম, তাপপ্রবাহের বিষয়টি মিলিয়ে এএনসি সেবা গ্রহণের হার কিছুটা কম। স্বাভাবিকের থেকে খুব বেশি কম নয়।’

নওগাঁ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে ৬২টি সেবা কেন্দ্র প্রসূতিদের সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালগুলো সেবা দিচ্ছে। নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সব ধরনের সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যাই কমেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে এএনসি কমে যাবে। জেলায় প্রায় ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছেন। আমরা চেষ্টা করছি যেন সেবা অব্যাহত থাকে।’

জেলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল আজিম জানান, ‘তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সেবা গ্রহণের হার কিছুটা কমতে পারে।’ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ সময় ধরে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জেএসআইয়ে কর্মরত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শুধু তাপমাত্রার কারণে যে প্রসূতিরা সেবা নিতে আসছেন না, এমনটি বলা যাবে না। যেকোনো দুর্যোগের কারণেই সেবা নেয়ার হার কমে যেতে পারে। দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি এখন রয়েছে, তাতে কেউ অতি জরুরি না হলে সেবা নিতে আসছেন না। গত কয়েক বছরে দেশে প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার হার বেড়েছে। এটা ভালো একটি বিষয়। তবে প্রথম ভিজিটে যারা যাচ্ছেন, চতুর্থ ভিজিটে গিয়ে তারা ঝরে পড়ছেন। এর পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে।’

তিনি বলেন, যারা পরিচিত সেবাদানকারীর কাছে যান অথবা যেসব সেবাদানকারী সেবাগ্রহীতাদের সম্পর্কে জানেন বা খুব কাছাকাছি থাকেন, তারা বাদ পড়লে তাদের ডেকে আনা হয়। এর বাইরে বাদ পড়াদের ডেকে এনে বা গিয়ে সেবা দেয়ার চিত্র তেমন একটা দেখা যায় না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মো. মুনীরুজ্জামান সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজধানীতে প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন তারতম্য দেখা যায়নি। যাদের প্রয়োজন হচ্ছে তারা হাসপাতাল বা সেবা কেন্দ্রগুলোয় এএনসির জন্য আসছেন। এ তাপমাত্রায় খুব প্রয়োজন না হলে গর্ভবতীদের ঘরের বাইরে না যাওয়াই বরং ভালো। যারা তাপমাত্রার কারণে এখন এএনসি নিতে পারছেন না তারা যেন পরবর্তী সময়ে বাদ না পড়েন, সেজন্য আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তাপমাত্রার কারণে সেবা নেয়ার হার ১০-২০ শতাংশ কমে যেতে পারে।’

তাপপ্রবাহ স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতীদের ঝুঁকি তৈরি করছে উল্লেখ করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, বিশ্বে প্রতি ১৬ সেকেন্ডে একটি মৃত সন্তানের জন্ম হয়। আর প্রতি বছর দেড় লাখ অপুষ্ট শিশুর (গর্ভাবস্থায় ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম হওয়া) জন্ম হয়। বিশ্বের ২৭টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অকাল জন্ম ও মৃত শিশু জন্মের হার ৫ শতাংশ বেড়েছে। তাপমাত্রার জন্য দায়ী মৃত শিশুর জন্ম ও অকাল প্রসবের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: