দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার আকার বেশ বেড়েছে। কিন্তু তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসকদের নৈতিক দুর্বলতা। এতে সঠিক সেবাপ্রাপ্তিতে যেমন রোগীর নিজস্ব ব্যয় বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অসন্তুষ্টি। সুস্থতার আশায় এখন যে পরিমাণ রোগী চিকিৎসকের কাছে যায় তাদের অর্ধেকই প্রাপ্ত সেবায় অসন্তুষ্ট। মূলত রোগীকে পর্যাপ্ত সময় না দেয়া, নির্দিষ্ট কিছু রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো, অপ্রয়োজনীয় ওষুধের পরামর্শ দেয়া ও কমিশন নেয়া, রোগীর অভিযোগ মনোযোগ সহকারে না শোনা এবং রোগীর প্রতি বৈষম্যের বিষয়গুলো সেখানে উঠে এসেছে বারবার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসা অবহেলা প্রতিকারের ক্ষেত্রে আইনি দুর্বলতাই ডাক্তারদের পেশাগত দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের অভাবকে বেশি প্রভাবিত করছে।
চিকিৎসক যদি পেশাগত নৈতিকতা অনুশীলন করেন, তাহলে শুধু রোগীর অধিকার রক্ষা পায় না, বরং এটি চিকিৎসকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা। যদিও বাংলাদেশে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে চিকিৎসা নৈতিকতার চর্চা সন্তোষজনক নয় বলে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
রোগীর কাছে নিজের পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপন, রোগীকে গুরুত্ব না দেয়া, সঠিকভাবে ব্যবস্থাপত্র না লেখা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ওষুধ দেয়া, রোগী পাঠিয়ে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে কমিশন বা অর্থ নেয়া, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি চিকিৎসকের পেশা চর্চা করতে গিয়ে মূল দায়িত্ব অবহেলা ইত্যাদি মোটাদাগে চিকিৎসা অনৈতিকতা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নৈতিকতার শক্ত অবস্থানে থেকে চিকিৎসকরা পেশা চর্চা করলে দেশে চিকিৎসা ব্যয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে আসবে।
পেশাগত নৈতিকতা বজায় রাখা চিকিৎসকের দায়িত্বের মৌলিক ভিত্তি বলে মনে করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নৈতিকতা আইনের ভিত্তি, তবে শুধু নৈতিকতার কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে এমনটি বলা কঠিন। আইন, বিধি ও তার বাস্তবায়ন প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় হতে হবে। চিকিৎসকদের নৈতিক করে গড়ে তুলতে আদর্শিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। সেবাগ্রহীতা এবং সেবাদাতার অধিকার কী হবে তা আইন বলে দেবে। তবে যথাযথ বাস্তবসম্মত আইন না থাকা এবং আইনের দুর্বলতা অনৈতিকতাকে প্রভাবিত করে। আইন দায়িত্ব সম্পর্কে বলে দেয়। নৈতিকতার স্থানে আইনের প্রবেশ নেই। আমাদের মেডিকেল শিক্ষায় চিকিৎসার নৈতিকতার বিষয়টি অনুপস্থিত। এটি চর্চার বিষয়।’
এ বিশেষজ্ঞের মতে, কতগুলো বিষয় রয়েছে যা নৈতিকতার, আবার কতগুলো রয়েছে যা আইনের অধীন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করার জন্য কমিটি রয়েছে। চিকিৎসক সঠিক ব্যবস্থাপনাপত্র লিখলেন কিনা, চিকিৎসা ঠিকমতো হয়েছে কিনা, রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসার প্রটোকল মানা হয়েছিল কিনা তা দেখে এ কমিটি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে বেসরকারি বাণিজ্যিকীকরণে ছেড়ে দিলে তা আর সেবা হয়ে থাকে না। দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি অবস্থান দুর্বল হয়েছে আর বেসরকারি অবস্থান শক্ত হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই স্বাস্থ্যকে এমনভাবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়া হয়নি। অন্যান্য পণ্যের মতো দেশে স্বাস্থ্যসেবা বিক্রয় করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেজন্য নৈতিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না।
দেশে বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্ত চিকিৎসকের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলের ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধেও। তার পরও চিকিৎসকদের নৈতিক দৃঢ়তার অভাব দেখা যাচ্ছে। যা শেষ পর্যন্ত রোগীর অসন্তুষ্টি, চিকিৎসা না পাওয়া ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রোগীদের বিদেশে যাত্রায় গিয়ে ঠেকছে।
গবেষণা বলছে, চিকিৎসকের বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন অর্ধেকের বেশি রোগী। ‘ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশনশিপ: এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের এ গবেষণা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশনা সংস্থা উইলি। যাতে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যকার সম্পর্ক তেমন ইতিবাচক না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত জনসাধারণ, রোগী ও চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি গবেষণায় তুলে আনা হয়েছে।
গবেষণায় চিকিৎসকের সম্পর্কে ৮০ শতাংশ জনসাধারণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। আর নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে ৬৭ শতাংশ রোগীর। জনসাধারণ ও রোগীদের কাছে গবেষকরা মূলত নয়টি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে চিকিৎসা প্রদানে চিকিৎসকের আন্তরিকতা, পর্যাপ্ত সময় দেয়া, মানসিক বিষয় বিবেচনা করা, রোগীর নিজস্ব মতামত শোনা, রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা, বিস্তারিতভাবে ব্যবস্থাপত্র বুঝিয়ে দেয়া, সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় বৈষম্য, চিকিৎসকের ওপর আস্থার বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। এগুলোর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বিষয়ে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যক্তি নেতিবাচক মতামত দিয়েছেন। একইভাবে রোগীদের বিষয়েও বেশির ভাগ চিকিৎসকের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়নি। রোগী এবং তাদের স্বজনরা চিকিৎসার বিষয়ে সহযোগিতাপূর্ণ নন বলে মন্তব্য ৭১ শতাংশ চিকিৎসকের। তারা চিকিৎসকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন ৬৭ শতাংশ। চিকিৎসায় কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে ৭৭ শতাংশ চিকিৎসক নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব মেডিসিনে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘পেশেন্ট স্যাটিসফ্যাকশন লেভেল অ্যান্ড ইটস ডিটারমেন্টস আফটার অ্যাডমিশন ইন পাবলিক অ্যান্ড প্রাইভেট টারশিয়ারি কেয়ার হসপিটালস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় রোগীদের সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ৬৫ শতাংশ, হাসপাতালের পরিবেশে ৫৭ শতাংশ, ৬৭ শতাংশ চিকিৎসকের সেবায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলা, বেসরকারিতে উচ্চ ব্যয়, সরকারিতে হয়রানি সেবার অসন্তুষ্টিতে প্রভাব রাখছে।
চিকিৎসকের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা বিএমডিসি। সংস্থাটির মতে, দেশে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৬৮ জন ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ও ১২ হাজার ৯৩০ জন ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) নিবন্ধনধারী চিকিৎসক রয়েছেন। বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শপথ নিয়ে চিকিৎসা পেশায় আসতে হয়। পেশাগত নৈতিক চর্চা কেমন হবে তা নিয়ে বিএমডিসির নীতিমালা বা নির্দেশিকা রয়েছে। তবে বেশির ভাগ চিকিৎসকই এসব পড়েও দেখেন না। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পেশাগত অনৈতিকতা এবং চিকিৎসা অভিযোগ উঠলে বিএমডিসি বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে।’
বিএমডিসির শৃঙ্খলা কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চিকিৎসক চিকিৎসায় ভুল করলেন কিনা তা সাধারণ কেউ বুঝবেন না। চিকিৎসক কীভাবে চিকিৎসা করবেন তা সম্পূর্ণ তার বিষয়। তবে কেউ কোনো অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করলে তা অপরাধ। এজন্য চিকিৎসকের পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিকতা দেখভালের সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে বিএমডিসি। আমাদের দেশে রেফারেল ব্যবস্থা নেই। ফলে রোগীর অপেক্ষার সময় বেশি হয়। চিকিৎসকস্বল্পতাও রয়েছে। বেশির ভাগ সরকার-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে পারছে না। রোগীকে মানসিকভাবে সন্তুষ্ট করতে হলে ভালো ব্যবস্থাপনা হওয়া জরুরি।’
১৮৪৭ সালে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (এএমএ) বিশ্বে প্রথম চিকিৎসকদের জন্য চিকিৎসা নৈতিকতা বা ইথিকস কোড প্রণয়ন করে। সংস্থাটি বলছে, চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতার বেশকিছু নীতি রয়েছে। সেগুলো হলো স্বায়ত্তশাসন, উপকারিতা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়বিচার ও উপযোগিতা। স্বায়ত্তশাসন বলতে একজন ব্যক্তির আত্মসংকল্পের প্রতি শ্রদ্ধা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর পছন্দকে বোঝায়। উপকারিতা অর্থাৎ রোগীদের ভালো করা। বিশ্বস্ততা একজন চিকিৎসকের কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতার প্রতি বিশ্বস্ততার ওপর জোর দেয়। ন্যায়বিচার নির্দেশ করে রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে একজন চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত ন্যায্য ও নিরপেক্ষভাবে নেয়া। আর উপযোগিতার ব্যাখ্যায় সংস্থাটি বলেছে, সম্পদের অপচয় না করে একজন রোগীকে সর্বাধিক সুবিধা দেয়া হবে এমন কার্যক্রম।
চিকিৎসা শিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নৈতিক জ্ঞানের অধ্যয়ন সন্তোষজনক নয় বলে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব প্রফেশনাল ইথিকস অ্যামং আ স্যাম্পল অব মেডিকেল প্র্যাকটিশনার ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়, বেশির ভাগ চিকিৎসক মেডিকেল ইথিকস বা চিকিৎসা নৈতিকতা শিখছেন বই পড়ে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নৈতিকতা শিখছেন লেকচার ও সাধারণ বই পড়ে। তবে ৯৭ শতাংশ চিকিৎসক মনে করেন চিকিৎসা শিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসা নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে যুক্ত করা প্রয়োজন। ৭৫ শতাংশ চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে মেডিকেল নৈতিকতার বিষয়ে গুরুত্বের কথা বললেও শতকরা ৩৫ শতাংশের এ বিষয়ে জানাশোনা খুবই কম। আর ৪৬ শতাংশের ধারণা গড় অবস্থানে রয়েছে।
বর্তমানে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যে কারিকুলামে তাদের পড়ানো হচ্ছে তাতে আরো বিস্তর নৈতিক শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। সারা জীবনের চিকিৎসায় কোনো চিকিৎসকের হাতে দুই-একজন রোগীর ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, তবে তাতে মেডিকেল প্রসিডিউর মানা হয়েছিল কিনা তা দেখতে হবে। এখন যেসব অনৈতিক চর্চা হচ্ছে তা অপরাধ। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকলে এসব কমে যাবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে তা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। ওই আইন বাস্তবায়ন হলে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হবে। আমলারা যেভাবে এ আইন করতে চাচ্ছেন তাতে চিকিৎসকের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং কিছু বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অতি মুনাফা অর্জনের কারণে রোগীদের অসন্তুষ্টি হচ্ছে। তবে পেশাগত নৈতিকতা একজন চিকিৎসকের প্রধান শর্ত। এর ব্যত্যয় হলে চিকিৎসা সঠিক হয় না। রোগীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করার চেষ্টা করছি। এতে রোগী ও চিকিৎসকের অধিকার রক্ষা হবে।’