বান্দরবান নার্সিং কলেজের ফটকের মুখেই জেলা হাসপাতালের মর্গ। জরাজীর্ণ একতলা ভবনের একটি কক্ষে সেই পুরনো ধাঁচে ছুরি-কাঁচি দিয়েই কাটা হয় অপঘাতে মৃতদের দেহ। মৃত্যুর কারণ জানতে কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই হয় ময়নাতদন্ত। এমনকি মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো ফ্রিজিং ব্যবস্থাও। নমুনা সংরক্ষণেরও কোনো আধুনিক সুবিধা নেই। একই অবস্থা নোয়াখালীর, জেলায় একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থাকলেও নেই নিজস্ব হাসপাতাল কিংবা মর্গ। আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের মর্গেই চলে কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পাঠ। সেখানেও আবার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চলছে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজ। তাই মানা যাচ্ছে না বৈজ্ঞানিক নির্দেশিকা।
কেবল বান্দরবান ও নোয়াখালীই নয়, এ যেন পুরো দেশেরই মর্গ ব্যবস্থার চিত্র। আবার যেসব সরকারি মেডিকেল কলেজে মর্গ রয়েছে, সেগুলোয়ও পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে ময়নাতদন্ত হয় না আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে। তাই পর্যাপ্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে না। একই সঙ্গে ডোমদের জন্যও নেই কোনো প্রশিক্ষণ, দেশে কাজটি চলছে বংশপরম্পরায়। আবার জেলা পর্যায়ে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণও থেকে যাচ্ছে অজানা। রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে গতানুগতিক।
যুক্তরাজ্যের দ্য রয়েল কলেজ অব প্যাথলজিস্টস বলছে, কয়েক ধরনের ময়নাতদন্ত রয়েছে। তবে মূল ময়নাতদন্ত দুই প্রকার—ফরেনসিক ও ক্লিনিক্যাল। এর মধ্যে ফরেনসিক ময়নাতদন্ত মূলত সন্দেহজনক, হিংসাত্মক বা মৃত্যুর অজানা কারণের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আর কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বা আরো ভালোভাবে কারণ বোঝার জন্য মৃতের নিকটাত্মীয়দের সম্মতির ভিত্তিতে করা হয় ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত। গবেষণার জন্য ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশে শুধু ফরেনসিক ময়নাতদন্তই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সূত্রে জানা যায়, যেসব স্থানের সরকারি মেডিকেল কলেজের মর্গ রয়েছে, সেসব জেলা হাসপাতালে মর্গ নেই। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর জন্য এসব মর্গ মূলত কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধীনে থাকে। যদিও দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে মর্গ রয়েছে মাত্র ১৮টিতে। এগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল, শেরেবাংলা মেডিকেল, রংপুর মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল, কুমিল্লা মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল, যশোর মেডিকেল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল, জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল, পাবনা মেডিকেল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।
বৈশ্বিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল প্যাথলজি অ্যাক্রিডিটেশন অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের ময়নাতদন্ত ও মর্গবিষয়ক গাইডলাইন গ্রহণযোগ্য। ‘রিকোয়ারমেন্ট ফর দ্য ফ্যাসিলিটিস অ্যান্ড অপারেশন অব মরচুয়ারি’ শিরোনামের নির্দেশিকায় সংস্থাটি ময়নাতদন্তের জন্য চারটি বিষয় উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে প্রথম স্তরে দেহ ব্যবচ্ছেদ ছাড়া বাহ্যিক পরীক্ষা; দ্বিতীয় পর্যায়ে উচ্চঝুঁকি বা বিশেষায়িত ময়নাতদন্তের জন্য অবকাঠামো ও কর্মীদের দক্ষতাসহ ব্যবস্থা; তৃতীয় স্তরে ময়নাতদন্তের জন্য নির্ধারিত পরিকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রাংশ ও দক্ষ কর্মী; সর্বশেষ বা চতুর্থ স্তরকে তারা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ময়নাতদন্ত বলছে।
মর্গ বলতে এক বা একাধিক কক্ষের ভবন, যেখানে মৃতদেহ সংরক্ষণ, রেফ্রিজারেটেড বডি স্টোরেজ সুবিধা, স্বজনদের মৃতদেহ দেখার জন্য আলাদা ব্যবস্থা, ময়নাতদন্তের জন্য ও শেষে দেহকে প্রস্তুত করার ঘর ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে উল্লেখ করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া বৈজ্ঞানিক শর্ত অনুযায়ী মর্গের মেঝে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দেহ ব্যবচ্ছেদের কক্ষ, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত, মৃতদেহের স্বজনদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, ময়নাতদন্তের পর দেহকে সত্কারের পদ্ধতি বুঝিয়ে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।
তবে দেশের অন্তত পাঁচটি মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতাল ঘুরে কোথাও এমন ব্যবস্থার দেখা মেলেনি। প্রায় বেশির ভাগ মর্গে নেই পানি, ভেন্টিলেশন, পর্যাপ্ত আলো ও ব্যবহূত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। মর্গে ভিসেরা (দেহের অন্ত্রের ভেতরের অংশ) সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নমুনা রাখার কনটেইনার, প্রিজারভেটিভ ও রাসায়নিকেরও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। মর্গগুলোতে নমুনা সংরক্ষণ করা হয় নিম্নমানের রাসায়নিক দিয়ে। আর অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা তো সেখানকার নিত্য ব্যাপার।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, মর্গের ভবন আধুনিক না হওয়ার কারণেই দেশে ময়নাতদন্তের এ দুরবস্থা। ফরেনসিক মেডিসিনে সুযোগ-সুবিধা না থাকলে চিকিৎসকরাও এখন আর এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে আগ্রহী হচ্ছেন না। শুধু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলিত থাকছে। তাই ফরেনসিক মেডিসিন চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, অল্প সময়ের জন্য মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে তা ২ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য হলে দেহকে সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে দেশের বেশির ভাগ মর্গেই মৃতদেহ সংরক্ষণের এমন ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে আবার বিকাল ৫টার পর দেশের কোথাও ময়নাতদন্ত করার বিধান নেই। মূলত দিনের আলোতেই কাজটি করতে এমন বিধান করা হয়েছে। ফলে বিকালের পর মর্গে আসা মৃতদেহকে সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজার জরুরি হলেও দেশের অনেক জেলায়ই সে ব্যবস্থা নেই। ময়নাতদন্তের জন্য মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির ল্যাবরেটরি প্রয়োজন হয়। আর রাসায়নিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন পড়ে কখনো কখনো। তখন সিআইডি পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়, যেটি দেশের একমাত্র রাসায়নিক বিশ্লেষণের ল্যাবরেটরি।
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ও জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী বণিক বার্তাকে বলেন, দিনের শেষে কোনো মৃতদেহ এলে তা মর্গে রেখে দেয়া হয়। পরদিন শুরুতেই সেই লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ফ্রিজার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়ে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি।
এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ময়নাতদন্ত আধুনিক রূপ পেয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো এ বিষয়ে কোনো আইন বা বিধিমালা করা হয়নি। ফলে গুরুত্ব পাচ্ছে না ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ময়নাতদন্ত। তাছাড়া সাধারণত দুদিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়াকে গ্রহণযোগ্য ধরা হলেও দেশে তার ব্যত্যয় ঘটছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের বিধিমালা ও গাইডলাইন করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের জন্য মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির ল্যাবরেটরি প্রয়োজন হয়। আর রাসায়নিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন পড়ে কখনো কখনো। তখন সিআইডি পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়, যেটি দেশের একমাত্র রাসায়নিক বিশ্লেষণের ল্যাবরেটরি। এছাড়া মৃতদেহ কাটাকাটির জন্য অন্তত ২৪ ধরনের যন্ত্র প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে জটিল ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এক্স-রে ও এমআরআই মেশিনের সাহায্য লাগে। অথচ দেশে কেবল পাঁচ-সাত ধরনের যন্ত্র দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। আবার যন্ত্র দিলেও তা ব্যবহারে পারদর্শী লোকবলের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ সোয়েব নাহিয়ান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আধুনিক যন্ত্র চালানোর লোকবল দেশে নেই। যেসব ডোম মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেন তাদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। তারা মূলত দেখতে দেখতে এসব শিখেছেন। তিরি আরো বলেন, ময়নাতদন্তে আমরা অন্যান্য দেশের মতো আধুনিক হতে পারিনি। তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের বাইরেও যেসব ডোম ময়নাতদন্তে সহায়তা করেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারলে কাজ আরো সুন্দর হতো।
ময়নাতদন্তে চিকিৎসকের সহায়তাকারী ডোম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বংশপরম্পরায় এ পেশায় আসছেন। এদের কারোরই নেই আধুনিক প্রশিক্ষণ। বান্দরবান জেলার ডোম মো. ওসমান প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশায়। আগামী দেড়-দুই বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এ পেশায় উপযুক্ত করে তুলতে তার নাতিকে সঙ্গে রেখে কাজ শিখিয়েছেন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিনে ১৯ জন অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছেন তিনজন, আট সহযোগী অধ্যাপক রয়েছেন ১৯ জনের বিপরীতে ও ২৭ জন সহকারী অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছেন কেবল ১১ জন। এ বিভাগে যারা প্রভাষক রয়েছেন তাদেরও বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রেষণে নিয়ে আসা। ফলে তাদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধরা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। সরকারি মেডিকেল কলেজে বেসিক সায়েন্সের এ বিভাগে ১৬৯টি পদের মধ্যে ৮৮টিই খালি রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ময়নাতদন্তের পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য হাজিরা ও প্রতিবেদন তৈরিতে চাপ থাকে। আবার আইনি কারণে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরও নিয়মিতভাবে কর্মস্থল ও আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তাই ফরেনসিক মেডিসিনে চিকিৎসকদের আগ্রহ কম। আর সে কারণে জেলা হাসপাতালগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকায় মেডিকেল অফিসারদের ময়নাতদন্ত করতে হয়। এতে ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ সঠিক না হওয়ার শঙ্কাও থেকে যায়। নির্ভুল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় ছাড় পেয়ে যায় অনেক অপরাধী। একই সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় পিছিয়ে থাকছে গবেষণার বিষয়ও।
মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা বণিক বার্তাকে এ বিষয়ে বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয় না। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত। আর ময়নতদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে ঝুঁকির বিষয়টি তো রয়েছেই। নিয়মিতভাবে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষী দেয়াসহ নানা কারণে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসকরা আসতে চান না। আক্ষেপ নিয়ে এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সেখানে ফরেনসিকের গবেষণায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।