ঠাকুরগাঁও জেলায় সম্প্রতি নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ গতকালও জেলাটিতে ১৮০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১০৩ জন করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। এ সময় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা রোগীর চিকিৎসায় জেলার সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আধুনিক সদর হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। জেলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধাও নেই। অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা উপকরণ ও ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে জেলাটি।
দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পিরোজপুরে তিনদিন ধরে ৫০ শতাংশের বেশি শনাক্ত হচ্ছে। বাড়ছে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যাও। সে তুলনায় রোগীর যথাযথ ব্যবস্থাপনা নেই। জেলা হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ৩২টি সাধারণ শয্যার সব ক’টিতে গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন। দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকলেও জেলার কোথাও আইসিইউ সুবিধা নেই।
দেশের এমন অন্তত ৩০টি জেলা জরুরি চিকিৎসা ও রোগী ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে। আবার এসব জেলায়ই সংক্রমণ বেশি। পিছিয়ে থাকা এসব জেলার রোগীরা নিজ জেলায় জরুরি চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাদের সঠিক ব্যবস্থাপনায়ও রাখা যাচ্ছে না। ফলে তাদের নিয়ে বিভাগীয় শহরে ভিড় করছেন স্বজনরা। তবে সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলায় চিকিৎসার সুবিধার সঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্পর্ক নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ১২৮টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ১৫টি সরকারি ও ২৮টি বেসরকারি হাসপাতাল। সারা দেশে বাকি ৮৫টি হাসপাতালের মধ্যে ৫২টিতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। একই সঙ্গে ২৩টি হাসপাতালে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুল সুবিধা এখনো যুক্ত হয়নি। দেশের মোট ৩৫ জেলায় আইসিইউ ও আট জেলায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার জরুরি চিকিৎসাসেবা এখনো চালু করতে পারেনি সরকার। ফলে প্রায় প্রতিদিনই এসব জেলা থেকে সংকটাপন্ন রোগীদের বিভাগীয় শহর বা অন্য কোনো জেলায় পাঠাচ্ছেন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুরে আইসিইউ সুবিধা নেই। একই সঙ্গে এ পাঁচ জেলায় মাত্র একটিতে ন্যাজাল ক্যানুলার সুবিধা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট, রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট, ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা ও শেরপুর, খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল, বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী এবং সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো আইসিইউ নেই।
এসব জেলার মধ্যে আটটিতে এখন পর্যন্ত হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যুক্ত করা হয়নি। সবক’টি হাসপাতালে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটের সমতুল্য শয্যা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা সক্রিয় নয়। এসব জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২ হাজার ৭০০ সাধারণ শয্যা রয়েছে।
সরকারের দেয়া করোনা-বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। এসব জেলার মধ্যে সর্বশেষ ৫০ শতাংশের উপরে শনাক্তের হার ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, হবিগঞ্জ ও পিরোজপুরে।
এসব জেলায় সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়ছে। ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার বণিক বার্তাকে জানান, জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মাসের শুরুতে এ জেলায় ২৯ শতাংশের উপরে রোগী শনাক্ত হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩৮ শতাংশ, তৃতীয় সপ্তাহে ৪২ শতাংশ এবং সর্বশেষ সপ্তাহে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ পেরিয়ে যায়। তিনি বলেন, করোনা রোগীদের জন্য জেলা হাসপাতালে ১০০টি সাধারণ শয্যা নির্ধারিত হলেও তাতে সংকুলান হচ্ছে না। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরো ১০টি করে শয্যা করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সংকটাপন্ন রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য জেলায় ব্যবস্থা নেই। তাই তাদের বিভাগীয় শহর রংপুরে পাঠানো হয়।
সরকার গঠিত করোনা-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সংকটাপন্ন রোগীকে প্রথমে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। এতে কাজ না হলে এইচডিইউ এবং শেষে আইসিইউতে নেয়া হবে। তবে অর্ধেকের বেশি জেলা হাসপাতালে এ ক্রমধারার ব্যবস্থাপনা নেই। শুধু শয্যা বা অন্যান্য সুবিধা বিবেচনা করে পিছিয়ে আছে কিনা তা বলা যাবে না। তবে এসব জেলায় করোনা রোগীদের জন্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না থাকায় সংক্রমণ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রমক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, জেলায় চিকিৎসা সুবিধার সঙ্গে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার সম্পর্ক নেই। সংক্রমণ অনেক কারণে বৃদ্ধি পায়।