হঠাৎ জীবনের ঝুঁকি তৈরি হলে মানুষের ভরসা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জরুরি বিভাগ। ওই সময়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে রোগীর পুনরুদ্ধার। দেশের টারশিয়ারি পর্যায় বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরশীল। যদিও জরুরি মুহূর্তে সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা নেই। সম্প্রতি এক গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে, যেখানে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের বেশির ভাগই নিজেদের দক্ষতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে জানান।
জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গবেষণা নিবন্ধটি জানুয়ারিতে প্রকাশ পেয়েছে। ‘ইজ লাইফ সাপোর্ট কম্পিটেন্সিস অ্যান আর্জেন্ট ইস্যু ইন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিকেল এডুকেশন (বিজেএমই)। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এতে দেশের চারটি করে আটটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক, শিক্ষক, শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের তথ্য নেয়া হয়েছে। আর তাতে দক্ষতা ও জ্ঞানের মূল্যায়ন করা হয়েছে চিকিৎসকদের নিজেদের মতামতের ভিত্তিতেই।
ঢাকার বাইরের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ডা. মেশকাত আহমেদ (ছদ্মনাম)। চলতি বছরই পেয়েছেন চিকিৎসকের চূড়ান্ত নিবন্ধন। জরুরি অবস্থার রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের বিদ্যমান জ্ঞান ও দক্ষতা পর্যাপ্ত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষানবিশরা হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ, বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে কাজ করেন। তবে জরুরি চিকিৎসায় তাদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত। বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় শিখন সুযোগ কিছুটা ভালো হলেও বেশির ভাগ হাসপাতালে তা নেই। পাঠ্যক্রম ও প্রশিক্ষণের দুর্বলতার কারণেই মূলত শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হচ্ছেন না। বিষয়গুলো শেখানো হয় অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে। যারা কিছুটা দক্ষতা অর্জন করছেন তা সম্পূর্ণ নিজ তাগিদে।’
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারির (এমবিবিএস) পাঁচ বছরের পাঠ্যক্রম শেষে একজন শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য সাময়িক নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। ওই সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী সুনির্দিষ্ট কলেজ হাসপাতালের রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন। শিক্ষক ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের সঙ্গে থেকে প্রশিক্ষিত হন। এরপর এক বছরের ইন্টার্নশিপসহ পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রিকে আমলে নিয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়মে চূড়ান্তভাবে চিকিৎসক নিবন্ধন দেয় বিএমডিসি।
বিজেএমইতে প্রকাশিত গবেষণায় পাঁচটি নির্দেশকের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জরুরি অবস্থায় লাইফ সাপোর্ট, শ্বাসনালি ব্যবস্থাপনা ও জরুরি ফার্মাকোলজি, কার্ডিওপালমোনারি ব্যবস্থাপনা, সাধারণ জরুরি পরিস্থিতিতে ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র লেখার পদ্ধতিগত দক্ষতা। পাঁচটি নির্দেশকের প্রায় সবক’টিতে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের দক্ষতা ও জ্ঞান গড় বা মধ্যম পর্যায়েরও কম। গবেষণায় দক্ষতা মান নির্ধারণ করা হয়েছে ছয়টি পয়েন্টে—শূন্য (০), খুবই কম (১), কম (২), গড় বা মধ্যম (৩), ভালো (৪) ও খুবই ভালো (৫)।
গবেষণায় বলা হয়েছে, হঠাৎ হৃদরোগের জটিলতা দেখা দিলে অ্যাডভান্স কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট (এসিএলএস), বেসিক লাইফ সাপোর্ট, কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) ও কার্ডিয়াক মনিটরের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের দক্ষতা গড় বা মধ্যম পর্যায়েরও নিচে। শ্বাসকষ্ট, দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া রোগীদের জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অ্যাডভান্স ট্রমা লাইফ সাপোর্ট (এটিএলএস), এয়ারওয়ে ব্যবস্থাপনা বা শ্বাসনালিতে বাধা প্রতিরোধ ও উপশম করার কৌশল, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া (শরীরের নির্ধারিত কোনো অংশকে অচেতন করা) প্রয়োগ, মুখ বা নাক দিয়ে শ্বাসনালিতে নল দেয়া বা এন্ডোট্র্যাকিয়াল ইনটিউবেশন, শ্বাসনালির অস্ত্রোপচার বা ট্র্যাকিওস্টমি ও ইন্টারকোস্টালের দক্ষতা কোনোটি মধ্যম পর্যায়ের নিচে; আবার কোনোটির গড় সীমারেখায়। জরুরি চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা, ওষুধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, ব্যবস্থাপত্র লেখা—এসব ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের দক্ষতাও অন্য ব্যবস্থাপনাগুলোর দক্ষতার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়নি। একইভাবে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা, নেবুলাইজেশন ও প্রাথমিক স্প্লিন্ট, ব্যান্ডেজের ক্ষেত্রেও তাদের দক্ষতা গড়পরতা।
হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থপনার ওপর গুরুত্ব দিয়েই মূলত গবেষণাটি করা হয়েছে বলে জানান এর প্রধান গবেষক ও সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক শিক্ষানবিশ ডা. উম্মে তাছকিয়া মুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন. ‘গবেষণাটির অংশবিশেষ জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা দেখোনোর চেষ্টা করেছি যে এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি রয়েছে, কিন্তু প্রশিক্ষণ যা দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কিনা। যারা ওই জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়েছেন তারা জরুরি মুহূর্তে কীভাবে সেবা দিতে পারছেন। মূলত নিজেদের দক্ষতা ও জ্ঞানের বিষয়ে তাদের মন্তব্য আমরা জানার চেষ্টা করেছি।’
ডা. উম্মে তাছকিয়া মুন জানান, এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বিত নয়। বিভিন্ন বিভাগের কিছু কিছু বিষয় বিক্ষিপ্তভাবে শেখানো হয়। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উন্নত করতে হলে শুরুতে চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যক্রমকে শক্তিশালী করতে হবে। কেননা কয়েক দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কখনই জরুরি ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। সব বিষয়ের চিকিৎসককেই জরুরি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। কেননা জরুরি মুহূর্তে কোনো চিকিৎসক যেন পিছিয়ে না যান। অন্যান্য দেশেও জরুরি চিকিৎসাকে গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখানো হয়েছে এবং সেভাবেই চিকিৎসাশিক্ষায় বিষয়টি রাখা হয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, তীব্রভাবে অসুস্থ ও আহতরাই মূলত জরুরি চিকিৎসার প্রত্যাশায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যায়। সারা বিশ্বে এমন জরুরি চিকিৎসা বিষয়টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। কেননা এ সময়ের চিকিৎসা রোগীর পুনরুদ্ধারের পথকে সুগম করে তোলে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংক্ষিপ্ত বলতে কোনো কিছুই নেই বলে মন্তব্য করেছেন ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল সায়েন্সে শর্ট বলতে কিছু নেই। সবকিছু জানতে হবে। ইমারজেন্সি মেডিসিনের উচ্চ ডিগ্রি চালুর সঙ্গে সঙ্গে কন্টিনিউং মেডিকেল এডুকেশন চালু করতে হবে। ডাক্তারদের বারবার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জরুরি বিষয়টি একবার প্রশিক্ষণ দিলে হবে না। সব বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যক্রমের কারণেই শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের জরুরি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব।’
সব দেশের জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এক নয়। ভৌগোলিক অবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে জরুরি ব্যবস্থাপনায় ভিন্নতা রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগের অর্থোপেডিক, চক্ষু, নিউরো, সার্জারি, হৃদরোগ, গাইনি থেকে শুরু করে সব চিকিৎসককে প্রশিক্ষিত করতে হবে। কেননা সবকিছুরই জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।’
চিকিৎসার জরুরি অবস্থা এমন বিষয় যা মানবস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে বলে উল্লেখ করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকারের স্বাস্থ্য ও বয়স্ক পরিচর্যা বিভাগ। সংস্থাটি বলছে, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরমভাবে আহত রোগীদের হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন। সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণেও জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। জরুরি চিকিৎসার সন্ধান করে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্ট্রোকের রোগীরা। সবাইকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারলে জীবনের ঝুঁকি কমে যায়।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসাশিক্ষা) অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রাধান্য রয়েছে। তবে তা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যদিও জরুরি বিভাগ পুরোপুরি তাদের ওপর নির্ভর করে না। ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসারই রোগীর প্রথম ব্যবস্থাপনা করেন। উপজেলা পর্যায়ে জুনিয়র কনসালট্যান্ট কাজ করেন। জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আরো দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন। এমবিবিএসের পাঠ্যক্রমে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ক্রিটিক্যাল কেয়ারে পড়ানো হয়। ক্রিটিক্যাল কেয়ারে কীভাবে রোগীর ব্যবস্থাপনা হবে, সেবা দেয়া হবে এসব সেখানে রয়েছে। তবে পাঠ্যক্রমকে আরো যুগোপযোগী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবর্তনশীল অবস্থার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। স্বতন্ত্রভাবে জরুরি চিকিৎসাসেবাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকদের সংকট রয়েছে।’