জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট: নেই ভাসকুলার সার্জন, ফিস্টুলার অপারেশনের জন্যও রোগীকে ছুটতে হয় অন্য হাসপাতালে

কিডনির জটিলতা নিয়ে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (এনআইকেডিইউ) আসেন ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এক গ্রামের বাসিন্দা সালেহা বেগম (ছদ্মনাম)। আট মাস আগে তার এ রোগ ধরা পড়ে। ততক্ষণে দুটো কিডনিই প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, এখন তাকে নিয়মিতই ডায়ালাইসিস করাতে হবে। আর ঝামেলাহীন এ সেবা পেতে হলে হাতে করাতে হবে ফিস্টুলা। তবে এনআইকেডিইউতে কোনো ভাসকুলার সার্জন বা রক্তনালির শল্য চিকিৎসক না থাকায় কাজটি করেন ইউরোলজিস্টরা। ফলে চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ ফিস্টুলার অস্ত্রোপচারই প্রতিষ্ঠানটি করতে পারছে না। সিরিয়াল না পেয়ে বছর চল্লিশের সালেহাকে তাই গত মঙ্গলবার নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটি হাসপাতালে।

কিডনি বিকল হওয়ায় যাদের ডায়ালাইসিস নিতে হয়, তাদের হাতে ফিস্টুলা করা হয়। এটি খুবই সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার, ব্যথামুক্ত উপায়ে চামড়ার ঠিক নিচেই ধমনি ও শিরার মধ্যে সংযোগ ঘটানো হয়। এর মাধ্যমে সহজে ডায়ালাইসিস করা যায়। রোগীর ব্যথা কম হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। ফিস্টুলা করা না থাকলে শিরায় ক্যাথেটার দিয়ে ডায়ালাইসিস করা হয়। এতে অবশ্য জটিলতা বেশি। সংক্রমণও হতে পারে।

এনআইকেডিইউর তথ্যমতে, দেশের দুই কোটি লোক দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছে। বছরে অন্তত ৩৫-৪০ হাজার ব্যক্তির দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়ে, যাকে বলা হয় এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ বা ইএসআরডি। মূলত এসব রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। তবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইনি প্রক্রিয়া মেনে কিডনি পাওয়া না গেলে রোগীকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ডায়ালাইসিস সুবিধা রয়েছে মোট ১৩০টি কেন্দ্রে। তবে বেসরকারিতে ডায়ালাইসিস বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই সরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়। আর জটিল রোগীরা চিকিৎসার জন্য ছুটে আসে জাতীয় পর্যায়ের বিশেষায়িত হাসপাতাল এনআইকেডিইউতে।

ফিস্টুলার মতো সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হলেন ভাসকুলার সার্জন। তবে দেশে কিডনি ও ইউরোলজির জন্য সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত (টারশিয়ার) প্রতিষ্ঠানটিতে এ ধরনের চিকিৎসক না থাকায় মূলত কাজটি করছেন ইউরোলজিস্টরা, তাও খুব সামান্য। ফলে বেশির ভাগ রোগীকেই পাঠাতে হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) কিংবা পাশের কোনো বেসরকারি হাসপাতালে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. সাইফ উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফিস্টুলার অপারেশনের জন্য বিশেষজ্ঞ হলেন ভাসকুলার সার্জন। তবে বাংলাদেশে ভাসকুলার সার্জন সংকট রয়েছে। কেউ যদি অন্য কোনো শাখার সার্জন হয়েও এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত বা অভিজ্ঞ হন তবে তারা তা করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো ভাসকুলার সার্জন একদিনে যে-সংখ্যক ঝুঁকিমুক্ত ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার করতে পারবেন তা অন্যরা পারেন না।’

তথ্য বলছে, প্রতি মাসে যে-সংখ্যক রোগীর ফিস্টুলা সার্জারি প্রয়োজন হয় তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ করা যায় এনআইকেডিইউতে। গত জানুয়ারিতে ইনস্টিটিউটের ইউরোলজিস্টরা ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার করেছেন মাত্র ৩০টি। আর ফেব্রুয়ারিতে ২১, মার্চে ৩৪, এপ্রিলে ২৫, মে মাসে ২৮ ও জুনে ফিস্টুলার সার্জারি হয়েছে ২৪ রোগীর। যদিও দিনে অন্তত ১০-২০টি ফিস্টুলার সার্জারির চাহিদা রয়েছে।

এনআইকেডিইউ কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালটির বিদ্যমান অর্গানোগ্রামে ভাসকুলার সার্জনের কোনো পদ নেই। অন্য কোনো হাসপাতাল থেকে এসব বিশেষজ্ঞকে প্রেষণে আনার ব্যবস্থাও নেই। ফলে নিজেদের সক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় তাদের পাঠাতে হয় এনআইসিভিডির ভাসকুলার সার্জারি বিভাগে। যদিও নতুন অর্গানোগ্রামে ভাসকুলার সার্জনের চাহিদার কথা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ রোগীকে আমরা ফিস্টুলার সার্জারি করতে পারি। আমাদের এখানে ইউরোলজিস্টরা ফিস্টুলা করেন। জরুরি রোগীদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অন্যদের আমরা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠাই। প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রামে মেডিসিন, ভাসকুলার সার্জন ও কার্ডিওলজিস্টের পদ রাখা হয়েছে। ডায়ালাইসিস ও অস্ত্রোপচারের সময় কোনো রোগীর কার্ডিয়াক সমস্যা হলে সেক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও আমরা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগিতা নিই।’

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠিত এনআইকেডিইউর যাত্রা হয় ২০০১ সালে। তবে রোগী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয় এর দুই বছর পর অর্থাৎ ২০০৩ সালে। সে সময় ১০০ শয্যায় রোগী ভর্তি করা হতো। প২০১২ সালে হাসপাতালটিকে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তা আরো বাড়িয়ে ৩০০ শয্যা চালুর কিছুদিন পর ৫০০ শয্যার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও বর্তমানে ৩০০ শয্যায় রোগী ভর্তির সুবিধা রয়েছে। তাও চলছে ১৫০ শয্যার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী।

রোগীসেবার পরিসংখ্যানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এনআইকেডিইউর বহির্বিভাগে গত বছর মোট ১ লাখ ৭৩ হাজার রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছে। জরুরি বিভাগের চিকিৎসা নিয়েছে সাড়ে নয় হাজার রোগী। আর বছরজুড়ে কিডনি রোগী ভর্তি ছিল সোয়া সাত হাজার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ১৬১ জনের। ওই বছর বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে দুই হাজার এবং ছোট পরিসরে হয়েছে পৌনে তিন হাজার। শুরু থেকে গত জুন পর্যন্ত কেবল ৫৩টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে দেশের বিশেষায়িত সরকারি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি। মূলত হাসপাতালটিতে কিডনির অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি ডায়ালাইসিস সেবাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে ভাসকুলার সার্জন না থাকায় ওই সেবাও ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ভাসকুলার সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সাকলায়েন রাসেল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা ফিস্টুলার সার্জারি করছেন তাদের বেশির ভাগই সার্জন নন। এটাও সত্য, বাংলাদেশে ভাসকুলার সার্জনের সংখ্যা কম। ফলে অনেক ইউরোলজিস্ট ফিস্টুলার সার্জারি করেন। যেহেতু ভাসকুলার সার্জন কম, তাই তাদের ফিস্টুলার সার্জারিকে আমরা অস্বীকার করছি না। তবে নেফ্রোলজিস্টরা (কিডনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ) ফিস্টুলার সার্জারি করলে বিষয়টিকে সমর্থন করি না। ডায়ালাইসিসের জন্য ফিস্টুলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে কোনো ত্রুটি থাকলে কিডনি রোগীর জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ন্যাশনাল কিডনি ফেডারেশন বলছে, ডায়ালাইসিস দুই প্রকার—পেরিটোনিয়াল ও হেমোডায়ালাইসিস। রক্তনালির (ভাসকুলার অ্যাকসেস) মাধ্যমে ডায়ালাইসিস মেশিন দিয়ে রক্তকে পরিশুদ্ধ করার পদ্ধতিকে হেমোডায়ালাইসিস বলা হয়। এ ধরনের ডায়ালাইসিসের জন্য হাতে ফিস্টুলা করা হয়। অপারেশনের মাধ্যমে রক্তনালিতে করা ফিস্টুলার মাধ্যমে খুবই কম সময়ে শরীরের সব রক্ত পরিশোধন করে আবার শরীরে ফিরিয়ে নেয়া যায়। অস্ত্রোপচারের এ কাজ করেন ভাসকুলার সার্জন।

সেবা অনুযায়ী দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুবিধা ও সক্ষমতা রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত কিডনি হাসপাতালে ভাসকুলার সার্জন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিওলজিস্ট না থাকা দুঃখজনক। আসলে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময় যে অর্গানোগ্রাম তৈরি হয়, তাতে প্রয়োজন বিবেচনা করা হয় না। এটি করেন মূলত আমলা ও চিকিৎসকরা। তবে চিকিৎসকদের ওপর আমলাদের কর্তৃত্ব থাকে। ফলে চিকিৎসকরা অনেক সময় বললেও আমলারা তা শোনেন না। সরকারি কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতারও ঘাটতি রয়েছে।’

বিশেষায়িত সেবা শুধু অবকাঠামো নয়, পরিপূর্ণ চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে জানান এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় এসব বিবেচনা না করায় দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ভঙ্গুর দশা। ভাসকুলার সার্জনের সংকট থাকায় অন্য সার্জনদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে ভাসকুলার সার্জনের সংখ্যা। অন্যথায় বিশেষায়িত সেবায় গলদ থেকে যাবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: