বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত তিন লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়। বছরে এক লাখের বেশি মানুষ মারা যায় রোগটিতে। ক্যান্সার রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একেবারে শেষ পর্যায়ে রোগীরা চিকিৎসার আওতায় আসছে। ফলে সে সময় চিকিৎসা হয়ে পড়ে জটিল। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয়টি টারশিয়ারি বা সর্বোচ্চ বিশেষায়িত পর্যায়ের হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া হয়। এ চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেডিওথেরাপি। যদিও এসব হাসপাতালে বিদ্যমান রেডিওথেরাপি মেশিনের ৫০ শতাংশই নষ্ট। এতে দীর্ঘ হচ্ছে রেডিওথেরাপির জন্য সংকটাপন্ন রোগীর তালিকা। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে যারা বেসরকারিতে যাচ্ছে তাদের ব্যয় করতে হচ্ছে কয়েক গুণ অর্থ।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার শুরু স্বাধীনতার আগে। ১৯৫৮ সালে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম রেডিওথেরাপি মেশিন বসানো হয় টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে। এর পর পরই ১৯৫৮-৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু করা হয় রেডিওথেরাপি মেশিন। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয়টি টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে ক্যান্সারের রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এসবের মধ্য ৫০ শতাংশ মেশিনই নষ্ট বা পরিত্যক্ত হয়েছে।
ক্যান্সারের প্রকারভেদে ও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করেন চিকিৎসকরা। এসব পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি। সাধারণত অস্ত্রোপচারের পর কেমোথেরাপি দেয়া হয়। এরপর দেয়া হয় রেডিওথেরাপি। একজন রোগীকে কয়টি রেডিওথেরাপি দেয়া হবে তা নির্ভর করে রোগের অবস্থা অনুযায়ী। তবে অন্তত ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অন্যান্য চিকিৎসার পর রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সরকারের বিশেষায়িত একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। প্রতিষ্ঠানটিতে রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর যন্ত্র রয়েছে চারটি, কোবাল্ট যন্ত্র রয়েছে দুটি ও ব্রেকিথেরাপি দেয়ার যন্ত্র রয়েছে দুটি। এর মধ্যে মাত্র একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর সচল ছিল। গত সপ্তাহে তাও নষ্ট হয়েছে। এর আগে গত বছরের মাঝামাঝি নষ্ট হয় একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিন। আর দুটি লিনিয়ার যন্ত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় সেগুলো বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে কোবাল্ট যন্ত্র দুটিও মেয়াদ শেষ হওয়ায় এক বছর আগে বাতিল করা হয়। ব্রেকিথেরাপি দেয়ার দুটি যন্ত্রের মধ্যে একটি নষ্ট।
তবে এনআইসিআরএইচের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিজামুল হকের দাবি, নষ্ট লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিনটি মেরামত করা হয়েছে। মেরামতের পর আজ মেশিনটি চালু করা হবে। এছাড়া আরো দুটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিন কয়েক মাসের মধ্যেই যুক্ত হতে যাচ্ছে।
এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আরো আটটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা।
এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে রেডিওথেরাপির জন্য একটি কোবাল্ট ও একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিনের মধ্যে কেবল কোবাল্ট মেশিনটি চালু রয়েছে। বহু বছরের পুরনো লিনিয়ার মেশিনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে শুধু আমাদেরই কোবাল্ট মেশিন রয়েছে। ক্যান্সারের মেশিনগুলো খুবই জটিল। পৃথিবীতে এসব মেশিন খুবই কম প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এছাড়া তাদের অনেক শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ মেশিনগুলোয় আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়।’
তিনি জানান, সরকারিভাবে কোবাল্ট মেশিনের রেডিওথেরাপির ফি ১০০ টাকা। একজন রোগীকে থেরাপি দিতে সাধারণত আধঘণ্টা সময় লাগে। দিনে মাত্র ২০-২৫ জনকে থেরাপি দেয়া যায়। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় থেরাপির তারিখ পেতে দেড়-দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ব্যবস্থাও থাকে। প্রতি বছর দেশে যে অনুপাতে ক্যান্সারের রোগী বাড়ছে সে অনুপাতে মেশিন নেই। একটি লিনিয়ার মেশিনের দাম ৩০-৫০ কোটি টাকা। কোবাল্ট মেশিনের দাম কিছুটা কম।
বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি কোবাল্ট ও একটি ব্রেকিথেরাপি মেশিন চালু রয়েছে। যদিও ২০০৬ সাল থেকে কোবাল্ট মেশিনটি নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। ছয় মাস আগে সেটি মেরামত করে চিকিৎসা দেয়ার উপযোগী করে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম।
সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে একটি কোবাল্ট মেশিন চালু রয়েছে। একইভাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু রয়েছে একটি কোবাল্ট ও একটি ব্রেকিথেরাপি মেশিন। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু রয়েছে একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি কোবাল্ট মেশিন চালু থাকলেও অকেজো হয়ে পড়ে আছে ব্রেকিথেরাপি মেশিনটি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ বছর ধরে একমাত্র কোবাল্ট মেশিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি মাত্র কোবাল্ট মেশিন চিকিৎসার উপযোগিতা হারিয়েছে। এ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিন এসেছে। তবে অবকাঠামোর অভাবে তা চালু করা যায়নি।’
এনআইসিআরএইচ জানিয়েছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য একটি মেশিন দেয়া হলেও সেটি এখন বাক্সবন্দি। এ হাসপাতালে প্রায় এক দশক ধরে লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর মেশিনটি পড়ে রয়েছে। জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য মেশিনটি কেনা হলেও অবকাঠামোগত সক্ষমতার অভাবে তা পাঠানো হয় খুলনায়। রেডিওথেরাপি চালু করার জন্য ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাংকার তৈরির কাজ চলছে।
রেডিয়েশন অনকোলজি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোবাল্ট যন্ত্রে লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটরের চেয়ে বেশি রোগীকে থেরাপি দেয়া যায়। সাধারণত যন্ত্র নতুন হলে দুই শিফটে কোবাল্টে ২০০ রোগীকে থেরাপি দেয়া সম্ভব। অন্যদিকে লিনিয়ার যন্ত্রে থেরাপি দেয়া যায় প্রায় ১০০ রোগীকে। তবে যন্ত্রের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্ষমতা কমতে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ক্যান্সার রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশের চিকিৎসার অংশ হিসেবে রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে স্তন, জরায়ু, কোলোরেক্টাল (পায়ুপথ ও বৃহদন্ত্র) ও ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য রেডিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বেই রেডিওথেরাপি যন্ত্র প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে রেডিওথেরাপি মেশিনের সংকট বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) বলছে, প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে রেডিওথেরাপির মেশিন প্রয়োজন শূন্য দশমিক ১৬টি। সে হিসেবে বাংলাদেশে মেশিন প্রয়োজন ১৭০টি। ২০৩০ সালে গিয়ে ২৪০টি মেশিনের প্রয়োজন পড়বে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রয়োজনের পরিমাণ আরো বেশি। এ মুহূর্তে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪০টির মতো রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি।
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কোনো ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই। বছরে সারা দেশে কত রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মারা গেছে এমন হিসাব সরকারের কাছে নেই। তবে গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্স (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যানের আলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) সর্বশেষ হিসাবে জানিয়েছে, বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে শনাক্তকৃত রোগীর মধ্যে এখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত ২ লাখ ৭১ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ক্যান্সার রোগীর।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাক্কলিত ক্যান্সারের রোগী রয়েছে ১৩-১৫ লাখ। প্রতি বছর আড়াই-তিন লাখ রোগী নতুন করে যুক্ত হয়। প্রাক্কলিত রোগীর সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ ক্যান্সার রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যায়। আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি রোগী শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার আওতায় আসে। মারা যায় প্রায় দেড় লাখ রোগী।
সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব কর্তৃপক্ষ ক্যান্সার চিকিৎসায় কাজ করে তাদের রেডিওথেরাপির গুরুত্ব বুঝতে হবে। শুধু চিকিৎসকদের ওপর দোষ চাপালে হবে না। প্রতিষ্ঠানপ্রধান মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত চিঠি দিলেই চলবে না, মন্ত্রণালয়কেও সাড়া দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মেশিনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একক বাণিজ্য রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে তো মেশিন নষ্ট হয় না। নষ্ট হলেও তা মেরামতে তো সময় লাগে না। তাহলে সরকারিতে কেন লাগবে? এর কারণ হলো সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসার বিষয়টি অবহেলিত। সরকারি হাসপাতালে মেশিন কখনই যেন ভালো থাকে না। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয় না। যারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করে তারাই আবার বেসরকারিতে যায়, ফলে সরকারিতে আগ্রহ কম। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
তবে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসায় সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বলে দাবি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের। তিনি জানান, বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার সেন্টার চালু করার জন্য অবকাঠামোগত কাজ চলছে।