সারা দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে চিকিৎসা পেতে ১০ টাকায় টিকিট কিনতে হয়। দেশের যেকোনো নাগরিক ১০ টাকার বিনিময়ে টিকিট কিনে চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। তবে খোদ রাজধানীতেই সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ দামে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১০ টাকার টিকিট ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গিয়েছে। হাসপাতালের কর্মচারী ও দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টিকিট বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।
বিশেষায়িত এ হাসপাতাল ঘিরে একটি অসাধু চক্র কাজ করছে বলে খবর মিলেছে। যাদের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তৃণমূল থেকে আসা ক্যান্সারের রোগীরা। প্রশাসনের চোখের সামনেই টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে রোগ নির্ণয়, রেডিওথেরাপি, ব্যাকিথেরাপি, কেমোথেরাপি সেবা নিতে, এমনকি হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে দৌরাত্ম্য দেখাচ্ছেন দালালরা। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
দেশের অন্য হাসপাতালগুলোর মতো ক্যান্সার হাসপাতালেও বহির্বিভাগ চালু থাকে সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। মূলত এ সময়কে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয় দালাল চক্র। ক্যান্সার হাসপাতালের বহির্বিভাগে নতুন রোগীর জন্য সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত টিকিট দেয়া হয়। আর পুরনো রোগীর জন্য টিকিট দেয়া হয় বেলা ২টা পর্যন্ত। সকালে টিকিট কাউন্টার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, আয়া, কর্তব্যরত আনসার সদস্যসহ বেশ কয়েকজন কর্মচারী ১০ টাকার টিকিট ২০০ টাকায় বিক্রির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় কাউন্টার থেকে রোগী বা রোগীর স্বজনদের কৌশলে টিকিট দেয়া হয় না। ফলে তারা এক ধরনের বাধ্য হয়ে অসাধু ওই চক্রের মাধ্যমে ১০ টাকার টিকিট ২০ গুণ বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন।
তিন কার্যদিবস জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, দুটি ভবনে রোগী ও রোগীর স্বজনদের জন্য পরামর্শমূলক লিখিত নির্দেশনার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সেবার নাম ও দাম লেখা থাকলেও তা এমন স্থানে সাঁটানো হয়েছে, যা রোগীদের নজরে পড়ছে না। আবার কোথাও কোথাও রাখা হয়েছে চরম অবহেলায়। নতুন ভবনের নিচতলায় বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারে রোগী ও স্বজনদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। এ ভিড়ের মধ্যেই মিশে থাকেন বহিরাগত দালাল চক্র ও হাসপাতালের অসাধু কর্মচারীরা। তারা রোগীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিভ্রান্ত করেন। ফলে যে সেবা রোগীর নিয়ম অনুযায়ীই প্রাপ্য, সেটি পেতে তাকে অযথা বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়।
গত শনিবার দুপুর ১২টার দিকে পটুয়াখালী থেকে আসা এক রোগীর স্বজন টিকিট কিনতে কাউন্টারে যান। তবে যথাযথ কাগজপত্র নেই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাকে। পরে ওই ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্য শাহ আলম তাদের বাড়তি ২০০ টাকায় টিকিট এনে দেয়ার প্রস্তাব দেন। ওই আনসার সদস্যকে ২১০ টাকা দিলে তিনি ঠিকই একটি টিকিট এনে দেন। অর্থাৎ কাউন্টার থেকেই শুরু হয়েছে চক্রটির কর্মকাণ্ড।
একটি সূত্র জানিয়েছে, আনসারের প্লাটুন কমান্ডার লোকমান হোসেন, টিকিট ক্লার্ক সুজন, জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয় আরকান শেখ, বহিরাগত স্বপন, রফিক, শাকিলসহ অন্তত ২০ জন এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। কথা হয় কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে। তারা বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবার কথা বলা হয় বাস্তবে সেবা পেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। দালাল থেকে শুরু করে কর্মচারীদের প্রতি পদে পদে অর্থ দিতে হয়। টাকা না দিলে বেশির ভাগ সেবাই মেলে না। এমনকি রোগী ভর্তি হওয়ার পর প্রয়োজনীয় বালিশ বা বিছানার চাদর পেতেও ওয়ার্ড বয় ও অন্য কর্মচারীদের টাকা দিতে হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো হাসপাতালের নিকটবর্তী ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য। রোগীদের বিভ্রান্ত করে এরা নিয়ে যায় এসব সেন্টারে। যেগুলোর বেশির ভাগই অবৈধ। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিদের মধ্যে পরিচিত হলেন রিলায়েন্সন মেডিকেল সেন্টারের এমরান, লাইফ কেয়ারের আশরাফুল ইসলাম, দ্য ঢাকা ব্লাড ব্যাংকের কামরুল, ব্লু স্কাইয়ের রিয়াদ এবং সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাহবুব।
মূলত হাসপাতালটির সিটি স্ক্যান, এমআরআই মেশিনসহ বেশকিছু রোগ নির্ণয় যন্ত্র নষ্ট থাকার সুযোগ নিয়ে এসব প্রতিনিধি রোগীদের তাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে মানসম্মত সেবা না পাওয়া গেলেও ব্যয় হয় মোটা অংকের অর্থ। বিশেষ করে গ্রাম থেকে যেসব রোগী আসেন তারা সবচেয়ে সহজে বিভ্রান্ত হন। এমনকি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে নিঃস্ব হয়ে চিকিৎসা শেষ না করেও ফিরে যেতে হয়েছে অনেককে।
তবে এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, তিন-চতুর্থাংশ যন্ত্রপাতি অকেজো ও নষ্ট থাকায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেহে ক্যান্সার তৈরি করে নিচ্ছে শক্ত অবস্থান। যন্ত্রপাতি নষ্ট ও কর্তৃপক্ষের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব হাসপাতালটির সব স্তরেই স্পষ্ট। ক্যান্সারের অনেক ধরন থাকলেও তার বেশির ভাগ শনাক্ত করার পরীক্ষা এ হাসপাতালে হয় না। ফলে চিকিৎসার প্রত্যাশায় আসা দরিদ্র রোগীরা সহজেই ধরা দেন দালালদের জালে।
সরকারি এ হাসপাতালে আনসারের ৬০ সদস্যের দল থাকার পরও স্থানীয় অসাধু চক্রের প্রকাশ্য আধিপত্য প্রমাণ করে যে এসব সমাধানে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আনসারের প্লাটুন কমান্ডার লোকমান হোসেন হাসপাতালের রাস্তায় ভাসমান দোকানগুলো থেকে অর্থ আদায় করেন বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আগত রোগীদের হয়রানি বন্ধ তাদের প্রধান দায়িত্ব হলেও উল্টো তারাই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে কোনো অর্থ কেউ দাবি করলে তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে। ১০ টাকার টিকিট কাউন্টারের বাইরে ২০০ টাকায় বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।