হৃদযন্ত্র মিনিটে কম-বেশি ৭০ বার পাম্প করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম বা শরীরচর্চায় সেটি সামান্য কম-বেশিও হতে পারে। কিন্তু হূত্স্পন্দন ১০০ বার বা তার কাছাকাছি হলে ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলে ট্র্যাকিঅ্যারিদমিয়া। আর জটিল এ সমস্যার একটি পার্টকে বলা হয় উলফ-পারকিনসন-হোয়াইট সিনড্রোম (ডব্লিউপিডব্লিউ)। এটির ক্ষেত্রে হূত্স্পন্দন মিনিটে ২০০ বার পর্যন্ত হতে পারে। তখন হৃদয়কে স্বাভাবিক করতে প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট চিকিৎসা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে রোগীর বয়সের সঙ্গে বেড়ে যায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। আর সরকারিভাবে কেবল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেই হৃদযন্ত্রের এ জটিলতার চিকিৎসা মেলে। তবে এ চিকিৎসার বিশেষ যন্ত্র কার্ডিয়াক ইপি (ইলেক্ট্রোফিজিওলজি) মেশিনের তার কেটে দিয়েছে ইঁদুর। তিন মাসেও সেটি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। তাই বন্ধ রাখা হয়েছে জটিল এ রোগের চিকিৎসা।
দেশে সরকারি পর্যায়ে জটিল হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য একমাত্র বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) সেবাকেন্দ্র জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ডব্লিউপিডব্লিউর জন্য ইলেক্ট্রোফিজিওলজি স্টাডি (ইপিএস) ও রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) করার জন্য কার্ডিয়াক ইপি মেশিন কেবল এ হাসপাতালেই রয়েছে। আর সেই মেশিনের ফাইবার অপটিক্যাল তার ইঁদুরে কেটে ফেলায় তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে ইপিএস ও আরএফএ সেবা। চিকিৎসা নিতে এসে প্রতিদিনই ফিরে যাচ্ছে রোগী। দেশের অন্য কোনো সরকারি হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। জটিল রোগের এ চিকিৎসাও মেলে কেবল চারটি বেসরকারি হাসপাতালে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভেদে ৭৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকারও বেশি গুনতে হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র রোগীদের জন্য সেখানে সেবা পাওয়া অসম্ভব। আর জাতীয় হৃদরোগে অস্ত্রোপচার খরচ (ওটি চার্জ) ৫ হাজার এবং ওষুধ ও রোগ নিরীক্ষার বিভিন্ন পরীক্ষা বাবদ এ চিকিৎসার খরচ পড়ে ১৫ হাজার টাকার মতো।
চিকিৎসাযন্ত্রের তার ইঁদুরে কেটে ফেলার মতো ঘটনা সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার চিত্র বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে এমন অবহেলার চিত্র হরহামেশাই লক্ষ করা যায়। যন্ত্রের জটিলতা বা অন্য কিছুতে চিকিৎসা বন্ধ থাকলে তো আর রোগ বসে থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি আরো জটিল হয়। এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ডব্লিউপিডব্লিউ জটিলতার চিকিৎসা সরকারি অন্য হাসপাতালে পাওয়া যায় না বলে একটি তারের অভাবে সেবাই বন্ধ। এমনটি আসলে মেনে নেয়া যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন বলছে, ডব্লিউপিডব্লিউ এক ধরনের অস্বাভাবিক হূত্স্পন্দন। বিশ্বে প্রতি হাজারে তিনজনের এ সমস্যা থাকে। সাধারণত হূিপণ্ডের কাঠামোকে বলা হয় অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার নোড, যা ওপরের চেম্বার থেকে নিচের চেম্বারে বিদ্যুৎ সংঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে কারো ডব্লিউপিডব্লিউ থাকলে তার হৃদযন্ত্রে এক বা একাধিক অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক প্রবাহের পথ তৈরি হয়। এর ফলে হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত হয়। প্রতি মিনিটে তা ২০০ বা তার বেশিও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডব্লিউপিডব্লিউ উপসর্গের মধ্যে দ্রুত হৃদস্পন্দন হওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, নিঃশ্বাসের দুর্বলতা, উদ্বেগ, অবসাদ, অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ রোগের চিকিৎসা না করলে শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে দ্রুত হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হওয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে অবশ্য লক্ষণগুলো চলে যেতে পারে আবার বৃদ্ধিও পেতে পারে। ওষুধে রোগের উপশম না হলে কার্ডিওভারশনের জন্য ইপিএস-আরএফএ করতে হয়। এ চিকিৎসার পদ্ধতিতে ইপিএস করে আরএফএ নামক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন প্রবাহ ঠিক করে হৃদস্পন্দনকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনা হয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০০৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ইপিএস এবং আরএফএ করে আসছে। মাসে প্রায় ৩০ রোগীকে এ সেবা দেয়া হয়। তবে ইপিএস-আরএফএ মেশিনের সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এক্স-রে মেশিনের সংযোগের ফাইবার অপটিক্যাল তারটি নষ্ট হওয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য ডব্লিউপিডব্লিউর চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তারটি আনতে বলা হয়েছে। বেশ মূল্যবান এ তার অবশ্য জাপান কিংবা জার্মানি থেকে আমদানি করতে হবে, তাই সময় লাগছে।
হাসপাতালের কার্ডিয়াক ক্যাথ ল্যাবে কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাইয়ের শুরুতে ল্যাবে ইঁদুর ঢুকে ইপিএস-আরএফএ মেশিনের সংযোগ তারটি কেটে দিয়েছে। তার আমদানির জন্য ক্রয়পত্র দিতেই তিন মাস লেগে গিয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষে তার এনে সংযোগের পর চিকিৎসা শুরু করতে আরো তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে। এ বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমি পরিচালক হিসেবে কেবল ২৫ হাজার টাকার ক্রয়াদেশ দিতে পারি। কিন্তু এ তারের দাম ১০ লাখ টাকা। এটা আমার ক্ষমতায় নেই। ফলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দিতে হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আমরা তারটি পেয়ে যাব। শিগগিরই পুনরায় চিকিৎসাসেবা সচল করতে পারব।
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট হাসপাতাল মিলিয়ে প্রায় ৬৫০ হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করে একমাত্র নিমিউ অ্যান্ড টিসি। দেশের বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় নেই। ফলে সারা দেশ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের কাছে যন্ত্র নষ্ট বা মেরামতের চাহিদা আসে। এতে ছয় থেকে নয় মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায় প্রক্রিয়া শুরু করতেই। তাই চিকিৎসাসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ এ কাজের জন্য নিমিউ অ্যান্ড টিসির ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালগুলো জরুরি সেবা দেয়, এর কর্তৃপক্ষকে বড় অংকের ক্রয়ক্ষমতা বা মেরামতে খরচের ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষকে জরুরি যন্ত্রাংশ মেরামত ও ক্রয়ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন। কেননা নিমিউ অ্যান্ড টিসির আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ কাজ করতে সময় লাগে বেশি। এ বিষয়ে ফাইলগুলো বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে কার্যকর হয়। ততদিনে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার জন্য রোগীর বাড়তি ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষায়িত সেবা নেয়ার সক্ষমতাও নিম্ন বা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।