নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বৈষম্য কমাতে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ‘জেন্ডার বাজেট’-এর আকার বাড়ানো হয়েছে। দেড় দশক আগে থেকে দেশে নারী উন্নয়নে জেন্ডার বাজেটকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়। এতে শুরুর অবস্থার চেয়ে বরাদ্দ দশ গুণ বেড়েছে। প্রস্তাবিত মোট বাজেটে জেন্ডার বরাদ্দের সম্পৃক্ততা ৩৪ শতাংশ। তবে বাজেটে নারী-পুরুষ সমতার বিষয়টি প্রতিফলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপের অভাব দেখছেন বিশ্লেষকরা। ফলে ২০৪১ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রসহ সব অবস্থানে নারী-পুরুষের যে সমতার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থেকে যাবে।
চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রস্তাবিত মোট বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। টাকার এ অংক নারী উন্নয়নে বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ১ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের সময় সহায়ক প্রকাশনা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে ‘জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০২৩-২৪’ প্রকাশ করা হয়। সেখানেই বিষয়টি উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ নারী উন্নয়নে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে নারী উন্নয়ন ও জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সরকারের ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অনুকূলে এ বরাদ্দ দেয়া হয়।
জেন্ডার বাজেটকে এখনো মূলধারার বাজেটের মতো দেখা হয় না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা। তার মতে, জেন্ডার বাজেটকে এখনো মূলধারায় না এনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একটি অংশ জেন্ডার বাজেটে অংশ নিলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয় না। বরাদ্দের অংক দেখে মনে হতে পারে বিশাল। তবে প্রকৃত অর্থে নারীদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য কতটা বরাদ্দ তা সুস্পষ্ট নয়।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেন্ডার বাজেট থাকায় লিঙ্গসমতার বিষয়টি আলোচনায় থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতদিন ধরে চলে আসা জেন্ডার বাজেটে নিঃসন্দেহে কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে আমরা যদি লিঙ্গসমতা অর্জন করতে চাই, তাহলে এটিকে মূলধারায় নিয়ে এসে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি কাজের মূল্যায়ন থাকতে হবে। ফলে বোঝা যাবে কোন খাতগুলো পিছিয়ে আছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে লিঙ্গসমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে সমতা অর্জন করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটাকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হবে। নারীদের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বাধা হয়ে রয়েছে সেগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।’
জেন্ডার বাজেটকে তিনটি থিমেটিক এরিয়ায় ভাগ করে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা বলা হলেও এ তিন ভাগে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫১ কোটি টাকার বণ্টন দেখানো হয়েছে। এতে ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি’ খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে জেন্ডার সম্পৃক্ত মোট বাজেটের ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১ লাখ ২ হাজার ৪৬৯ টাকা, ‘উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ’ খাতে ৮ দশমিক ১ শতাংশ বা ১৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা ও ‘সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি’ খাতে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৫৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
জেন্ডার বাজেটে অস্পষ্টতা দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। একটি রাস্তা তৈরি করা হলো—নারীর জন্য তৈরি করা হয়েছে বললে সঠিক মূল্যায়ন হলো না। কেননা এটি নারী-পুরুষ সবাই ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, জেন্ডার বাজেট ও জেন্ডার খরচের পার্থক্য রয়েছে, বিষয়টি তথ্যের অস্পষ্টতা। জেন্ডার বাজেটের ফলে আগে কতটুকু সমতা অর্জিত হয়েছে তার স্পষ্ট মূল্যায়ন প্রয়োজন। তবেই বোঝা যাবে জেন্ডার বাজেট কতটুকু কার্যকর হচ্ছে ও ভবিষ্যতে কী করতে হবে। করোনা অভিঘাতে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। সেজন্য এসব বিষয়ে বাজেট বৃদ্ধির দরকার ছিল। নারী বাজেটে বিশেষ কোনো বরাদ্দ নেই। নারীরা দক্ষতা অর্জনের পর কতদূর কাজ করতে পেরেছে তার মূল্যায়ন নেই। বাজেট বরাদ্দ ও আউটকাম বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজ করলে জেন্ডার সমতা অর্জন করা সম্ভব।’
নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও ছয়টি বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়। দ্বিতীয় অংশে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নয়টি মন্ত্রণালয় ও দুটি বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়। তৃতীয় অংশে সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়। এতে ১২টি মন্ত্রণালয় ও নয়টি বিভাগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শেখ ইমতিয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এবারের জেন্ডার বাজেটটি গতানুগতিক। নতুন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আগের জেন্ডার বাজেটে যেটি বরাদ্দ ছিল সেটি কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা নিয়ে কোনো ধরনের মূল্যায়ন ছিল না। এ বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।’