জেলা পর্যায়ে মিলছে না জরুরি চিকিৎসা: রাজধানীতে ভর্তি করোনা রোগীর সিংহভাগই ঢাকার বাইরের

পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব সাজেদা বেগম চাঁদপুরের বাসিন্দা। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর প্রথমে জেলার স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু রক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন (অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা) কমে যাওয়ায় জেলায় তাকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। জেলাটিতে করোনা চিকিৎসার জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। গত বুধবার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এখানে বর্তমানে তাকে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে।

সংকটাপন্ন অবস্থায় পঞ্চাশোর্ধ্ব মোহাররমকে ডিএনসিসির ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন তার ছেলে শাকিল। পাবনার বাসিন্দা মোহাররম জেলায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাননি। জেলাটিতে একটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকলেও নেই আইসিইউ সুবিধা। শুরুতে পাবনা থেকে পিতাকে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে নিয়ে গিয়েছিলেন শাকিল। কিন্তু সেখানেও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় পিতাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন তিনি।

রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতেও এখন করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। এসব জেলার অধিকাংশেই নেই উন্নত জীবনদায়ী সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। এ কারণে জেলাগুলো থেকে কভিড রোগীরা সংকটাপন্ন অবস্থায় এসে ভিড় করছেন রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালে। রাজধানীর কভিড ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে করোনা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া রোগীর ৭০ শতাংশই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। জেলা পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা স্বল্পতার কারণে বাধ্য হয়েই তাদের ঢাকায় নিয়ে আসছেন স্বজনরা।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে এভাবে ঢাকার দিকে ছুটতে হতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে ১৬টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং ২৭টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত চার সপ্তাহ ধরে এসব হাসপাতালে আগের তুলনায় রোগী ভর্তির হার বেড়েছে। গতকালও সরকারি ১৬ হাসপাতালের মধ্যে সাতটিতে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। এসব হাসপাতালে ১১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। পাঁচটি হাসপাতালে ৭১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ২০টি খালি ছিল। করোনা রোগীদের জন্য অস্থায়ীভাবে নির্মিত ডিএনসিসি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ২১২টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৩৪টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন। তবে এ হাসপাতালের সব আইসিইউ এখনো সক্রিয় হয়নি বলে জানা গেছে। অন্য তিন হাসপাতালে একটিতেও কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

রাজধানীর বেসরকারি ২৭টি হাসপাতালের মধ্যে ১১টি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের গতকাল সবক’টি সব শয্যায় সংকটাপন্ন করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন। বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যার ৭০ শতাংশে রোগী ভর্তি ছিল। একই সঙ্গে সাধারণ শয্যায়ও রোগী বেড়েছে। গতকাল এসব ৪৩ হাসপাতালে প্রায় ৬০ শতাংশ সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন।

রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি করোনা হাসপাতালের তথ্য বলছে, করোনা ইউনিট, আইসিইউ ও এইচডিইউতে ভর্তি রোগীর তিন-চতুর্থাংশের কাছাকাছি সংখ্যক এসেছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে। বেশির ভাগ জেলায় প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা না থাকায় সংকটাপন্ন অবস্থায়ই তারা রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন। বেশির ভাগ রোগীই সংকটাপন্ন অবস্থায় এসব হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। বিভাগীয় হাসপাতালেও ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি থাকায় তারা ঢাকায় এসেছেন।

দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বণিক বার্তাকে জানান, এ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি রোগীর সিংহভাগই দেশের অন্যান্য জেলা থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যাই বেশি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য আগত রোগীর অর্ধেকই সংকটাপন্ন অবস্থায় আসছেন বলে জানালেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া করোনা রোগীর ৬০-৭০ শতাংশ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। ভর্তি হতে আসা অর্ধেক রোগীর অবস্থায়ই সংকটাপন্ন। ১০টি আইসিইউ শয্যার সবক’টি এখন রোগীতে পূর্ণ। একটা শয্যা পেতে অনেক রোগী অপেক্ষমাণ থাকছেন। এ অবস্থায় আইসিইউ ইউনিটে আরো ১০টি শয্যা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি।

রাজধানীর বেসরকারি করোনা হাসপাতাল পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংকটাপন্ন কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের জন্য ৪২টি আইসিইউ শয্যা বরাদ্দ রয়েছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে এর সবক’টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। ১০ জনের বেশি সংকটাপন্ন রোগী আইসিইউ শয্যার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন। সাধারণ ও আইসিইউ শয্যায় ভর্তির ৭০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. ইশতিয়াক। এছাড়াও ভর্তির সময় অনেকে ঢাকার আত্মীয়ের ঠিকানা লিখছেন বলে জানালেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক কর্মকর্তা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড ১৩০টি হাসপাতালের মধ্যে ৫২টিতে আইসিইউ সেবা নেই। ১৭টি হাসপাতালে নেই হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। এর মধ্যে ৩২টি জেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় আইসিইউ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা রাজধানীর মতো গড়ে ওঠেনি। একই সঙ্গে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতরা এখন কভিড পজিটিভ রোগীর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়ে ওঠেনি। তারা কেন্দ্র থেকে সেসব সুবিধা ও নির্দেশনা পাননি। ফলে জেলা পর্যায়ের অপূর্ণতা এবং অদক্ষতার ফলে রাজধানীতে রোগীরা ভিড় করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তারা কী করছেন সেটা এখনো কেউ পর্যবেক্ষণ করছেন না। জেলা পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা ও করোনা রোগীদের ব্যবস্থাপনা জোরদার করা উচিত। একই সঙ্গে সংক্রমণ কমানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে মহামারী শুরু হওয়ার পর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকারি সংস্থাগুলো জরুরি চিকিৎসার পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করতে পারেননি।

তবে জেলা পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা জোরদার করা হচ্ছে বলে জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কোনো রোগীই সরকারি হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। রাজধানীতে রোগী এলে তাদেরও ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তবে উপজেলা পর্যায়ে কাঠামোতে অনেক জরুরি সেবা নেই। সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: