ঢাকা ও ময়মনসিংহ ছাড়া দেশের ৬২টি জেলায় আছে সদর বা জেলা হাসপাতাল। সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের কাছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম এ হাসপাতালগুলো। করোনা মহামারী শুরুর পর যখন গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রয়োজন দেখা দিল, তখন এসব জেলা হাসপাতালের নানা সংকটের চিত্র সামনে আসতে শুরু করে। দেখা যায়, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এ হাসপাতালগুলোর এক-তৃতীয়াংশেই নেই আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের সুযোগ।
নওগাঁ জেলা হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্ন্নীত করা হয়েছিল গত বছরের অক্টোবরে। তবে তা কেবল কাগজে-কলমেই। কারণ প্রায় সাত মাস পরও সেখানে ২৫০ শয্যার সেবা চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ অপারগতার জন্য লোকবল ও জরুরি যন্ত্রাংশসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুধু নওগাঁ জেলা হাসপাতালে নয়, যথাযথ অবকাঠামো না থাকায় দেশের মোট ১৯টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা সম্ভব নয়।
চলমান করোনা মহামারী মোকাবেলায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের অবকাঠামো আছে কিনা তা যাচাইয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হয়। যাচাই শেষে গণপূর্ত অধিদপ্তর গত ১০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে একটি চিঠিতে বিস্তারিত জানায়। সেই চিঠি থেকেই জানা যায় ১৯ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের অবকাঠামো না থাকার কথা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (পিপিসি) মো. মাহফুজুল আলম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের ১৯টি জেলা হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) ইউনিট ও ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। জেলাগুলো হলো মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও রংপুর।
অবকাঠামোগত যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তার প্রধান হলো বেশির ভাগ জেলা হাসপাতাল ভবনগুলো পুরনো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, একটি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করতে গেলে অনেকগুলো বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন, যে ভবনে আইসিইউ স্থাপন করা হবে, সেটি এ সুবিধার জন্য যথাযথ কিনা। সেখানে রোগীদের সেবা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা আছে কিনা। এমন একটি ভবন বা কক্ষ থাকতে হবে, যেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থাসহ বিশেষ কিছু কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য থাকবে। এরপর সেবা চালু করার জন্য অন্য বিষয়গুলো যুক্ত করলেই সেখানে আইসিইউ সেবা দেয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের অবকাঠামো নেই, সেগুলোর ভবনগুলো অনেক পুরনো। সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানো যাবে না। সংক্রমণ প্রতিরোধী যে ব্যবস্থা নিতে হয়, কাঠামোগত কারণে তা-ও নেয়া যাবে না। পুরনো ভবনগুলো অনেক আগে নির্মাণ করায় আইসিইউর কথা তখন চিন্তা করা হয়নি। সে কারণে এখন চাইলেও এসব ভবনে আইসিইউ ইউনিট চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, করোনা মোকাবেলায় জেলা পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসা সেবা উন্নত করার লক্ষ্যে নেয়া ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনা, জেলা হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ১০ শয্যার আইসিইউ ও ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের কথা রয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার’ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মোহাম্মাদ আজিজুল রহমান সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সব জেলায় সদর বা জেলা হাসপাতাল নেই। একে তো পুরনো ভবন, তার ওপর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় সবগুলোতে আইসিইউ স্থাপনও করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের অনেক জেলা হাসপাতালকে ১০০ থেকে ১৫০ বা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করা হলেও লোকবল ও অবকাঠামো বাড়ানো হয়নি। কোনো কোনো জেলায় নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও রাখা হয়নি আইসিইউ স্থাপনের জন্য সুবিধা। তেমনই নওগাঁ জেলা হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও সমপরিমাণ লোকবল বা যন্ত্রাংশ বাড়ানো হয়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সাইদুল হক।
তিনি বলেন, জনবল ও যন্ত্রাংশ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চাহিদা দেয়া হয়েছে। আমাদের এ হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও ১০০ শয্যার সুবিধা বহাল রয়েছে। পুরনো ভবনে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কাজ চলছে।
একই কথা জানালেন কুড়িগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বর্তমান অবকাঠামোয় আইসিইউ স্থাপনের সুযোগ নেই। তবে সেখানেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানো হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বাদে দেশের বাকি ৬২টি জেলায় সদর বা জেলা হাসপাতাল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৫টি সদর বা জেলা হাসপাতালে স্বল্পসংখ্যক আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। এসবের কিছু জেলা হাসপাতালকে সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নীত করেছে সরকার। সেসব স্থানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে এসব স্থানে আলাদা করে জেলা হাসপাতাল থাকছে না। আবার অনেক জেলা হাসপাতালে আইসিইউ না থাকলেও আশপাশে হয়তো বিশেষায়িত বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, সেবাপ্রত্যাশীরা জেলা হাসপাতালগুলোতে কম যান। তারা চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোকেই প্রাধান্য দেন।
সে কারণে জেলায় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটের জন্য অবকাঠামো বানানো হয়নি। তাছাড়া সেখানে আইসিইউ স্থাপনের মতো অবকাঠামোগত সুবিধা নেই বলেও জানান সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হোসাইন সাফায়েত।
অন্যদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের চিঠিতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটের জন্য অবকাঠামো নেই বলা হলেও আদতে বিষয়টি তা নয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল সালেহিন জানান, তাদের হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিউ ও ৮ শয্যার এইচডিইউ (হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, অবকাঠামো না থাকায় সব জেলা হাসপাতাল অথবা সদর হাসপাতালে আইসিইউ দেয়া যাবে না। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয়তাও দেখতে হবে। কেননা পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব সুবিধা থাকায় চিকিৎসা প্রত্যাশীরা জটিল রোগে জেলা হাসপাতালে আসেন না। তাছাড়া আইসিইউ স্থাপনের জন্য যে জনবল দরকার হয় তারও সংকট রয়েছে। টাকা দিয়ে আইসিইউ ইউনিট হয়তো স্থাপন করা যাবে, কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল পাওয়া কঠিন।
তিনি আরো বলেন, আইসিইউ স্থাপনের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু হাসপাতালের অবকাঠামো পুরনো হলে সেখানে এসব নিশ্চিত করা যায় না।