টানা পাঁচদিন লাখের নিচে টিকা প্রয়োগ: দৈনিক সক্ষমতার ৭০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে

নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গত মাসে দেশব্যাপী টিকা প্রয়োগ শুরু হয়। এর তিনদিনের মাথায় দৈনিক টিকাগ্রহীতার সংখ্যা দুই লাখ অতিক্রম করে। বর্তমানে তা এক লাখের নিচে নেমেছে। আর গত পাঁচদিন ধরে এ সংখ্যা লাখের নিচেই রয়েছে। অথচ সরকারের গণটিকাদান কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনায় দৈনিক সাড়ে তিন লাখের বেশি টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা রয়েছে। সেই হিসেবে সক্ষমতার ৩০ শতাংশেরও কম টিকা প্রয়োগ হচ্ছে। অর্থাৎ সক্ষমতার ৭০ শতাংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে টিকা গ্রহণ কমার পাশাপাশি নিবন্ধনের সংখ্যাও কমেছে। তবে কারো কারো অভিযোগ, নিবন্ধনের পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও টিকা দেয়ার তারিখ জানানো হয়নি।

দেশে গণটিকা প্রয়োগ শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। এর তিনদিনের মাথায় ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম এ সংখ্যা লাখ অতিক্রম করে। তারও চারদিন পর দৈনিক দুই লাখ মানুষ টিকা নেয়া শুরু করে। এর মধ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন ব্যক্তি টিকা নেন। তবে এর পর থেকে টিকা নেয়া মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। গত পাঁচদিনে যা দৈনিক লাখের নিচে নেমেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ৯৪ হাজার ৪৩৭ জন টিকা নিয়েছেন। আর গতকাল সাধারণ ছুটি থাকায় টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৩৯১ জন নারী-পুরুষ টিকা নিয়েছেন। মোট টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ ও ৩৭ শতাংশ নারী।

অন্যদিকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭০ জন টিকাপ্রত্যাশী অনলাইনে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। দেশে বর্তমানে ১ হাজার ৫টি কেন্দ্রে টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব কেন্দ্রে মোট ২ হাজার ৪০০ দল টিকা প্রয়োগের কাজ করছে। প্রতি দলে দুজন টিকা প্রয়োগকারী এবং চারজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রতি দল দৈনিক ১৫০ জনের শরীরে টিকা প্রয়োগে সক্ষম বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে হিসেবে দৈনিক সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের শরীরে টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা রয়েছে। তবে ৩০ শতাংশেরও কম টিকা প্রয়োগ হচ্ছে। নিবন্ধনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় টিকা প্রয়োগ মন্থর হয়েছে বলে মনে করছেন ভাইরাস ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। প্রথমদিকে অনেক মানুষ টিকা নিয়েছেন। নিবন্ধনের সংখ্যাও বেশি ছিল। সে সময় মূলত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যারা পাওয়ার কথা তারাই বেশি নিয়েছেন।

করোনা বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশব্যাপী টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু হলে কোনো কোনো দিন দুই-আড়াই লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন। এখন এ সংখ্যা লাখের নিচে। মূলত তখন সাধারণ মানুষ কম টিকা নিয়েছেন, এখনো কম নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকা বিষয়ে এখনো প্রবল আগ্রহ ও বিশ্বাস তৈরি হয়নি। এজন্য সরকারেরই পদক্ষেপ নিতে হবে।

মানুষকে টিকার উপকারিতা উল্লেখ করে সচেতন করতে হবে বলেও মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে আগ্রহের ঘাটতি থাকায় স্বাভাবিকভাবেই নিবন্ধনের সংখ্যা কমেছে। অক্সফোর্ডের টিকার বিষয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) বলছে। বিভিন্ন দেশে যে কারণে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ স্থগিত করা হয়েছে, সেসব ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি।

টিকার জন্য সরকারের সুরক্ষা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা নিবন্ধন করে টিকা নিচ্ছেন। চল্লিশোর্ধ্ব ছাড়াও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ২০ ধরনের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তি নিবন্ধন করে টিকা নিচ্ছেন। এতে ৪০ বছরের নিচের ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত। অগ্রাধিকার পাওয়া ব্যক্তিদের বাইরে সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই নিবন্ধনের ৩০ দিন পরও টিকা গ্রহণের তারিখ জানতে পারেননি বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। এমনকি অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরাও টিকা গ্রহণের তারিখ পাচ্ছেন না।

অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তানিয়া আক্তার (৩২)। ২৯ দিন আগে নিবন্ধন করেন তিনি। এখন পর্যন্ত তিনি ক্ষুদেবার্তা পাননি। রাজধানীর ব্যবসায়ী আবু তাহের (৫৯) গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করেন। এরপর ৩০ দিন পেরিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত টিকা গ্রহণের তারিখ সংবলিত ক্ষুদেবার্তা পাননি তিনিও। আবু তাহেরের সঙ্গে তার স্ত্রীও একই তারিখে নিবন্ধন করেন। তিনিও ক্ষুদেবার্তা পাননি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো কোনো কেন্দ্রের বিপরীতে বেশিসংখ্যক নিবন্ধন হওয়ায় ক্ষুদেবার্তা দেরিতে পাঠানো হচ্ছে। এটা তেমন কোনো গুরুতর সমস্যা নয়, এটা সাধারণ ঘটনা।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মাধ্যমে দেশে গণটিকাদান শুরু করে সরকার। একই টিকা বিশ্বের অন্তত আটটি দেশে প্রয়োগের কয়েক সপ্তাহ পরই কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। সেসব দেশে এ টিকা প্রয়োগের ফলে বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানা গেছে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে টিকা গ্রহণকারী ৮৯৭ জনের শরীরে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

টিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় নিবন্ধনের সংখ্যা কমেছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এ টিকা প্রাপ্তবয়স্কদের দেয়া হচ্ছে। এটা নেয়ার বিষয়ে মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ না চাইলে তাকে জোর করে দেয়া হচ্ছে না। সরকার প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে টিকা দেবে। সাময়িকভাবে নিবন্ধনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় টিকা প্রয়োগের সংখ্যাও কমেছে। তবে টিকার পক্ষে প্রচারণার জন্য নতুন কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে নেই বলেও জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ পদস্থ কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকাদান কেন্দ্রে টিকা দেয়া হয়। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা কিনছে সরকার। এরই মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ দেশে এসেছে। ভারত সরকার উপহার হিসেবে দিয়েছে আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা। করোনা টিকার জন্য গড়ে ওঠা বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে ৬ কোটি ৯০ লাখ ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। জুনের মধ্যে এ টিকার ১ কোটি ৯ লাখ ডোজ পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। এর বাইরে আরো তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য চেষ্টা করছে সরকার।

Source: Bonik Barta

Share the Post: