ডলার সংকট: জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আমদানি কমেছে ৯১%

দেশে ওষুধের জোগানের ৯০ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করে স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো। বাকি যেটুকু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলো প্রধানত ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ও স্নায়বিকসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। জটিল পরিস্থিতিতে রোগীর জীবন রক্ষায় ব্যবহূত এসব ওষুধের আমদানিতেও এখন বিরূপ প্রভাব ফেলছে ডলার সংকট। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) অতিপ্রয়োজনীয় এসব ওষুধের আমদানি কমেছে ৯১ শতাংশ। ওষুধের পাশাপাশি হ্রাস পেয়েছে কাঁচামাল আমদানি। একই সঙ্গে কমেছে ওষুধ শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও।

আমদানীকৃত ওষুধ ও উপকরণের অভাবে এখন জটিল অস্ত্রোপচারও হ্রাস পেয়েছে বলে চিকিৎসক ও বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, বাজারে এখন আমদানীকৃত যেসব ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোরও দাম অনেক বেড়েছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে আগামী জুন-জুলাই নাগাদ প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট তীব্র হওয়ার পাশাপাশি জটিল অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে মোট ওষুধ আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ৫৩ কোটি ৬৪ লাখ বা ৫৩৬ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে মাত্র ৪৫ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলারের। এ অনুযায়ী গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ওষুধ আমদানিতে এলসি কমেছে ৯১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একই পরিস্থিতি ওষুধ আমদানির এলসি নিষ্পত্তিতেও। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ওষুধের এলসি নিষ্পত্তি ছিল ৫৪৭ মিলিয়ন ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ওষুধ আমদানিতে মাত্র ৪৯ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। এ হিসাবে ওষুধ আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৯০ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ আমদানিতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির কারণ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, গত অর্থবছরে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন ও কভিড টেস্ট কিট আমদানির চাপ ছিল। চলতি অর্থবছরে এ চাপ নেই। ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ ব্যাপক মাত্রায় কমে যাওয়ার পেছনে এর ভূমিকা আছে। আবার ডলার সংকটের কারণেও ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ ও ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির নতুন এলসি কমেছে ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ৭০৪ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতের নতুন এলসির পরিমাণ ৫৫৪ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আবার ওষুধের কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৬৪১ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতের এলসি নিষ্পত্তি ৫৮০ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে দেশে উৎপাদিত ওষুধের দামও এখন বাড়ছে। এক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিও বড় ভূমিকা রাখছে।

উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে ওষুধ শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে যন্ত্রপাতি আমদানিতে খোলা নতুন এলসি কমেছে ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ১২০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হলেও চলতি অর্থবছরে তা মাত্র ৭২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ খাতের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি নিষ্পত্তিও ৩১ শতাংশ কমেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানি কমেনি। তবে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

ডলার সংকটে ওষুধের পাশাপাশি এখন ক্যান্সার, কিডনি, চর্মরোগ, হৃদরোগ, স্নায়বিক ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহূত মেডিকেল ডিভাইসেরও সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে অভাব দেখা দিয়েছে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত বিভিন্ন রি-এজেন্টের (রোগ-নিরীক্ষার বিভিন্ন উপকরণ)। এতে জরুরি বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন বন্ধের পথে।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভাষ্য হলো, বিদেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতকৃত যেসব ওষুধ আমদানি করা হতো তা এখন প্রায় বন্ধ। এলসি খুলতে না পারায় এমনটি হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ওষুধ আমদানির পরিমাণ কমেছে। দেশে প্রধানত ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনিসহ বেশকিছু রোগের ওষুধ আমদানি করা হয়। ঘাটতি পড়লে সব ওষুধেরই পড়বে, কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের পড়বে না। কারণ ওষুধ প্রস্তুতে ব্যবহূত কাঁচামালের ৮৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এখন এলসি খুলতে চায় না ব্যাংক। এখন যে কাঁচামাল আছে সেটুকু দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাস চলা যাবে। দুই-আড়াই মাস ধরে প্রয়োজনীয় অংকের এলসি খুলতে পারছেন না কাঁচামাল আমদানিকারকরা।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে পেট্রোকেমিক্যালের দামের ঊর্ধ্বগতি। এছাড়া তুরস্কের বর্তমান অবস্থাও খারাপ। সর্বোপরি বৈশ্বিক অবস্থা ভালো না। যার ফলে আমরা একা একা ভালো থাকতে পরি না। এছাড়া ডলারের সংকট রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কাঁচামালের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আমরা খারাপ পরিস্থিতির কথা জানিয়েছি। এলসি খুলতে চায় না ব্যাংক। আমরা প্রাইভেট ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে খুলতে চায় না। তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের এলসি খুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। আর কাঁচামাল সংকট হলে তখন তো পাওয়া যাবে না। আগামী মাস থেকেও সংকট তৈরি হতে পারে। দুই মাসের মতো সময় ধরে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা যাচ্ছে না।’

দেশের টারশিয়ারি পর্যায়ের চারটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করতে না পারায় হৃদরোগের অস্ত্রোপচার আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে হৃদরোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে। মানবদেহের হূদযন্ত্রের ভালভ রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখে। এ ভালভ অকেজো হয়ে পড়লে অকার্যকর হয়ে পড়ে অতিগুরুত্বপূর্ণ হূদযন্ত্র। তখন কৃত্রিম ভালভ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বর্তমানে আদমানিনির্ভর এ ভালভের সংকট খুব বেশি। একই সঙ্গে সংকট দেখা দিয়েছে হূদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখার অক্সিজেনেটরেরও।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দেশে অক্সিজেনেটর ও ভালভ সরবরাহ করে বেসরকারি চারটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে প্রায় গড়ে প্রায় ১৫০ ভালভ প্রয়োজন হয়। চার মাস ধরে এ সরবরাহ ৫০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে। আর অক্সিজেনেটরের চাহিদা ভালভের চেয়ে তিন গুণ বেশি থাকলেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।

দেশে ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস প্রস্তুত এবং আমদানিকারক অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ওষুধ আমদানি করা হয়। আর চীন, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয় ওষুধের কাঁচামাল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল সংগ্রহে প্রভাব পড়েছে। এতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিভাইস উৎপাদন করতে পারছে না। একই সঙ্গে করোনা মহামারীর কারণে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বহু কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না। হার্টের ভালভ ও অক্সিজেনেটর আমদানি করা হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ডিভাইস তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে মূলত বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা অক্সিজেনেটরের কিছুটা সংকটে রয়েছি। এছাড়া কিছু যন্ত্রাংশে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসা চালিয়ে নিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমাদের কার্ডিয়াক সার্জারি বন্ধ নেই।’

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে মেডিকেল ডিভাইস ও ওষুধ আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে জানান, চার-পাঁচ মাস ধরে চেষ্টা করে কিছু হূদযন্ত্রের ভালভ সংগ্রহ করা গেছে। তবে অক্সিজেনেটরের সংকট সবচেয়ে বেশি। এ সংকট আরো কঠিন হচ্ছে। ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইসের চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও সংকট আমদানিতে প্রভাব ফেলেছে। স্বাস্থ্যগত বিষয়ে এলসি খোলা গেলেও তাতে জটিলতা রয়েছে। চাহিদার তুলনায় ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস আমদানি এখন আগের চেয়ে অনেক কমেছে। যেটুকু আমদানি করা যাচ্ছে, সেটুকুতেও দাম দিতে হচ্ছে আগের চেয়ে তিন গুণ।

ঔষধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২০৬টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৪৬ হাজার ৫০৭ মিলিয়ন টাকার ওষুধ এবং ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করছে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে।

বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও ওষুধ উৎপাদনে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এএম শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি থেকে শুরু করে যেসব জটিল রোগের ওষুধ আমদানি করা হতো তা এখন স্থানীয় উৎপাদনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আগে যেখানে ১০ কোটি ডলারে এলসি কেউ খুলতে পারতেন, সেখানে খুলতে পারছেন ২০ লাখ ডলারের এলসি। তাও চার-পাঁচটি ব্যাংক ঘুরে এলসি করতে হচ্ছে। এ সংকট শুরু হয়েছে গত জুনে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী জুন-জুলাইয়ে সংকট আরো তীব্র হবে।

তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ সাধারণত চার জায়গায় থাকে। ফার্মেসি, ডিপো, ওয়্যারহাউজ ও কারখানা। এগুলোর চেইন শেষ হতে সময় লাগবে। সাধারণত তিন-চার মাসের ওষুধ থাকে। আমাদের দেশে কম দামে ভালো ওষুধ পাওয়া যায়। অন্য কোথাও থেকে ওষুধ আনা কঠিন। কেননা আস্থার একটি বিষয় থাকে। কাঁচামালের আমদানি কমেছে, ওষুধ আমদানিও কমেছে। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চাচ্ছে না। যেমন গাড়ির জন্য এলসি খুললে ব্যাংকের লাভ রয়েছে। ওষুধের জন্য খুললে লাভ তাদের কম বিধায় তারাও আগ্রহ দেখায় না। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: