কক্সবাজারে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জনের মৃত্যু হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে সংখ্যাটা ২৩। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়া এ জেলাটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার লোক। অধিদপ্তরের তথ্যে অবশ্য সেটা দেড় হাজারের কিছু বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে বরিশাল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার স্থানীয় হিসাবের সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে রয়েছে বেশ গরমিল। আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না গেলে সেই রোগী ও মৃত্যুর হিসাব ওঠে না সরকারের খাতায়।
জাতীয়ভাবে ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য গণমাধ্যম ও জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিয়মিতভাবে দৈনিক মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির তথ্য দেয়া হয়। তবে সরকারের দেয়া তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন কীটতত্ত্ব, রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারি হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। আবার আংশিক ওই তথ্যকে পূর্ণাঙ্গ ধরে প্রকাশ করাও অনৈতিক। এতে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে বেশ বেগ পেতে হয়। এমনকি মহামারীও দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে চলতি বছর এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পরিস্থিতি দেখে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তালিকায় সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে তথ্য থাকলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নেই। একই সঙ্গে হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগী ও মৃত্যু হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের দেয়া গতকালের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৯ হাজার ডেঙ্গু রোগী। ভাইরাসজনিত এ রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ১৪৮ জনের। রাজধানী ঢাকায় গতকালও ৫৩২ ও ঢাকার বাইরে ৪৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে সাতজন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যের সঙ্গে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যের মিল নেই। অন্তত পাঁচটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ ও একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গে অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যের অসংগতি দেখা গিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে সোমবার পর্যন্ত শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিল আড়াই হাজারেরও বেশি রোগী। আর মারা গিয়েছে অন্তত সাতজন। অথচ অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হয়েছে, হাসপাতালটিতে এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৬৫৪ জন আর মারা গিয়েছে পাঁচজন।
কক্সবাজারেও সোমবার পর্যন্ত চলতি বছর ১৬ হাজার ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা। বাকি দেড় হাজার কক্সবাজারে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশী। মৃত্যুতেও এগিয়ে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। জেলাটিতে ৩৬ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৮ জনই রোহিঙ্গা। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে মৃতের সংখ্যা ২৩ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬২৬ জন। একইভাবে চট্টগ্রাম জেলায় ১৫ জনের মৃত্যু হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে তা কম দেখানো হয়েছে। এ জেলায় ২ হাজার ৭৪০ ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও অধিদপ্তরের তথ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। জেলার তথ্য বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে পাঠানো হয় উল্লেখ করে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, জেলা সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ তথ্যগুলো প্রস্তুত করেন। এরপর আমরা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিই। সাধারণত দিনের তথ্য দিনেই পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় ২০টি সরকারি ও ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে সে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এসব তথ্য ডেঙ্গুবিষয়ক জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করে অধিদপ্তর। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারা দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, যার তথ্য নেই সরকারের কাছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হিসাবও সঠিক নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সে সময় ১৭৫ মৃত্যুর কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।
রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী থাকে তার অন্তত পাঁচগুণ বেশি পাওয়া যায় ওই এলাকায়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে হাসপাতাল এলাকা অর্থাৎ ওই শহর বা গ্রামে জরিপ করলে দেখা যাবে, ১০ রোগী ভর্তি হলেও বাস্তবিক অর্থে চিকিৎসার বাইরে রয়েছে ৫০ জন। এ পদ্ধতিতে এনসেফালাইটিসের (জীবাণুঘটিত মস্তিষ্কের প্রদাহ) বেলায় জরিপ করা হয়েছিল। কোনো রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র না এলে সঠিকভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার পদক্ষেপ নেয়া যায় না বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলে মানুষ আতঙ্কিত হবে—এমন একটি ভুল ধারণা সরকারের রয়েছে। অথচ সঠিক তথ্য জানালে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। গত বছর দেখা গিয়েছে, হাসপাতালে রোগী ভর্তি হলেও সময়মতো পরীক্ষা হয়নি। যেমন ডেঙ্গু এনএস-১ পরীক্ষা দু-তিনদিনের মধ্যে না হলে নেগেটিভ হবে। আবার ডেঙ্গু আইজিএম আগে করলে ও সাতদিন পর করলে নেগেটিভ হবে। তখন দেখা যায়, ওই রোগী মারা গিয়েছেন কিন্তু তিনি ডেঙ্গু পজিটিভ নন। হাসপাতালও ডেঙ্গুতে মৃত্যু স্বীকার করে না। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরের রোগীকে হিসাবের আওতায় আনা হচ্ছে না। সংখ্যা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি বিড়ম্বনায় পড়লেও দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ নেয়া যাবে।
সারা দেশের সব তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যই ডেঙ্গুবিষয়ক জাতীয় তথ্যের একমাত্র উৎস। রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালের তথ্য পাওয়া গেলেও ঢাকার বাইরের কোনো বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য এখন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, জেলার তথ্য নির্দিষ্ট সার্ভারে সংযুক্ত করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব একসঙ্গে প্রকাশ করে। তবে হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগী ও মৃত্যুর হিসাব এখন যুক্ত করা হচ্ছে না।