দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আক্রান্তের তুলনায় এবার মৃত্যুহার বেশি। প্রতিদিনই এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে দুই-আড়াই হাজার রোগী। কখনো কখনো তা তিন হাজারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে যাওয়ায় এবার রোগ শনাক্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের তিন-চতুর্থাংশই আবার ভর্তির তিনদিনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। মূলত দেরিতে চিকিৎসা শুরু হওয়ার কারণে মৃত্যুহারটা বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
রাজধানীর মধ্যে আবার বেসরকারির চেয়ে দ্বিগুণ মৃত্যু হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, শুরুতে ডেঙ্গু শনাক্ত না হওয়া, রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পর সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার কারণেই মূলত সরকারি হাসপাতালে মৃত্যুহার বেশি। তাছাড়া যেসব রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ থাকে তাদের বেশির ভাগ সময়ই বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভর্তি নিতে চায় না। উপায় না পেয়ে স্বজনরা রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতালভিত্তিক ডেঙ্গুবিষয়ক সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকার হাসপাতালগুলোয় গতকাল পর্যন্ত ৬৪ হাজার ১৭২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ২০টি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে কিংবা নিচ্ছে ৩৭ হাজার ৩৭২ জন, (মোট রোগীর ৫৮ শতাংশ)। আর বেসরকারি ৫৬টি হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৬ হাজার ৮০০ জন বা ৪২ শতাংশ রোগী। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোট মৃত্যু হয়েছে ৪৯৭ ডেঙ্গু রোগীর। সরকারি হাসপাতালে মারা গেছে ৩৬৩ জন বা ৭৩ শতাংশ। আর বেসরকারি হাসপাতালে ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা মোট মৃতের ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে রাজধানীর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর বিপরীতে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। বেসরকারিতে এ হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ বেসরকারির চেয়ে সরকারি হাসপাতালে মৃত্যুহার প্রায় দ্বিগুণ।
রাজধানীর তিনটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় সাধারণত সংকটাপন্ন রোগীই বেশি আসছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য হাসপাতাল থেকে আংশিক চিকিৎসা নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এসে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। আবার বেসরকারি হাসপাতালগুলো ক্রিটিক্যাল রোগীদের দায় নিতে চায় না বলে তাদেরও সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অনেক রোগী এমন সময় হাসপাতালে আসছে যখন চিকিৎসকদের আর তেমন কিছু করার থাকে না।
সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল পর্যন্ত সরকারি এ হাসপাতালে প্রায় সাড়ে নয় হাজার রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০৭ জনের। ভর্তি রোগীর অনুপাতে মৃত্যুহার ১ দশমিক ১২ শতাংশ। একক কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে দেশের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছে ১২১ জন। ভর্তি রোগীর বিপরীতে মৃত্যুহার ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে যেসব রোগী রয়েছে তার অর্ধেক বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংকটাপন্ন অবস্থায় পাঠানো হয়েছে। দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে দুদিন রেখে তারপর সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর আমাদের এখানে কেউ চিকিৎসা নিতে এলে তো ফিরিয়ে দিতে পারি না। রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে আসছে। দেখা যায়, কেউ কেউ আংশিক চিকিৎসা নিয়ে এসেছে। ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মৃত্যু প্রভাবিত হয়। আমাদের হাসপাতালে যারা মারা গেছে তার ৯৫ শতাংশই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকে মৃত্যু হয়েছে। এর সিংহভাগই অন্য হাসপাতাল থেকে এসে এখানের আইসিইউতেই ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু এমন সময় রোগীদের পাঠানো হচ্ছে বা তারা নিজেরা আসছে তখন চিকিৎসকদের করার তেমন কিছু থাকে না। ফলে দিন শেষে মৃত্যুর দায় আমাদের নিতে হচ্ছে।’
একই কথা জানিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী মো. রশিদ-উন-নবী। তার মতে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শুরুতে রোগীরা হাসপাতালে আসছে না। তার হাসপাতালের বেশির ভাগ রোগীরা কোনো না কোনো হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে সংকটাপন্ন রোগীদের আইসিইউতে রেখেও বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তার মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের মৃত্যু হচ্ছে তিনদিনের মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এ বিশ্লেষণ গত সোমবার জানানো হয়েছে। রোগীরা যখন হাসপাতালে আসছে তখন চিকিৎসকদের তেমন কিছু করার থাকছে না। সেক্ষেত্রে জ্বর হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ দেখলেই হাসপাতালে ভর্তির জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
রাজধানীতে স্বাস্থ্য কাঠামো পরিপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সচ্ছল মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছে। আর অসচ্ছল মানুষ যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। নিম্ন আয়ের মানুষের বেসরকারি মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ নেই। কেননা ডেঙ্গু একটি মাত্র পরীক্ষায় শনাক্ত কঠিন। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে তখন তারা সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। রাজধানীর স্বাস্থ্য কাঠামোয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের সেবার সরকারি ব্যবস্থা নেই। একই মেডিকেল কলেজে সব সেবা দেয়া হয়। ফলে সাধারণ মানুষ সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে চাইলেও তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। সেখানে এত মানুষের চাপ যে কেউ মারাত্মকভাবে রোগাক্রান্ত না হলে যেতে চায় না। পরে যখন অবস্থা খারাপ হয় তখন গেলেও অনেক ক্ষেত্রে বাঁচানো যায় না। শহরে যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা থাকত তাহলে রোগীদের বাঁচানো যেত। সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের উচিত বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা। তাতে শুরুতেই রোগ শনাক্ত হলে ব্যবস্থা নেয়া সহজ।’
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেই মন্তব্য করে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলো মানুফা নিতে ব্যস্ত। সরকারের উচিত এখানে দায়িত্বশীল আচরণ করা। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেবা দিতে বাধ্য থাকে এ ব্যবস্থা করা। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। চাইলেই যেন কোনো চিকিৎসা বা রোগ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো দাম রাখতে না পারে। মুনাফার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল হবে না। এক্ষেত্রে তারা কোনো রোগী সংকাটাপন্ন হলে ফিরিয়ে দিতে পারত না।’
সরকারি হাসপাতালগুলো জটিল রোগীর চিকিৎসা দেয় বেশি, তাই মৃত্যুহারও বেশি বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে কেউ চিকিৎসা নিতে এলে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। আমরা জনগণকে সেবা দিতে বাধ্য। সাধারণত সরকারি হাসপাতালগুলোয় সংকটাপন্ন রোগী বেশি আসছে, তাই মৃত্যুহার বেশি। আসলে সেবার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বলতে কিছু নেই। সবাইকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়। আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা দিতে।’ এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার আরো ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে এ সময়ে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে ২ হাজার ৬৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৯৯ ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ৭৯০ জন। গতকাল সন্ধ্যায় এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯ হাজার ৭১১ জন চিকিৎসাধীন আছে। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ১৫১ ও অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৫৬০ জন ভর্তি রয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৬৪ হাজার ১৭২ ও ঢাকার বাইরে ৭৬ হাজার ৫৩৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৩০৯ জন। ঢাকায় ৫৯ হাজার ৫২৪ ও ঢাকার বাইরে ৭০ হাজার ৭৮৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল গত বছর, ২৮১ জন। চলতি বছর অনেক আগেই সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া ডেঙ্গুতে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে সাত ও ২০২১ সালে মৃত্যু হয় ১০৫ জনের।