বিশ্বে দ্রুতবর্ধনশীল শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকা অন্যতম। শহরের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী, উত্তরে তুরাগ নদ ও টঙ্গী খাল এবং পূর্বে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী। এসব নদ-নদী ও খাল ব্যবহূত হয় বাণিজ্য, পরিবহন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য। অপরিশোধিত পয়োনিষ্কাশন, কঠিন বর্জ্য ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য নির্বিচারে নদীতে ফেলার কারণে গত তিন দশকে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানির গুণগত মানের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার পাশাপাশি এ কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা। বাড়ছে রোগের প্রাদুর্ভাব। আবার নদীতে মাছ শিকার, নদীর তীরে কৃষি ও নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ কমে যাওয়ায় পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে তীরবর্তী বাসিন্দারা।
সাধারণত নদীর তীরে যারা বাস করে তারা দৈনন্দিন জীবনের পানির জন্য নদীর ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর পানি দূষিত হয়ে গেলেও নিরাপদ পানির অভাবে তীরবর্তী মানুষ দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজের জন্য সেই পানির ওপরই নির্ভর করছে। পয়োনিষ্কাশন সুবিধার অভাবের কারণে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর নারী, কিশোরী ও শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নদীর বিষাক্ত পানিতে সাঁতার কাটার ফলে শিশুদের মধ্যে নানা ধরনের রোগের সংক্রমণ ঘটছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ কমিউনিকেশনস জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘রিভার পলিউশন অ্যান্ড সোশ্যাল ইনইকুয়ালিটিস ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় রাজধানীর নদীদূষণের কারণে আর্থসামাজিক ও ঋতুগত গতিশীলতার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পাঁচ গবেষক তুরাগ নদ ও টঙ্গী খালের তীরবর্তী ২৫ কিলোমিটার এলাকার ১ হাজার ৮০০-এর বেশি গৃহস্থালির ওপর গবেষণা করেন। এতে নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা কীভাবে নদী ব্যবহার করে তা যেমন তুলে আনা হয়েছে, তেমনি বাসিন্দাদের জীবনে এর প্রভাবও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তুরাগ নদ ও টঙ্গী খালকে চারটি এলাকায় বিভক্ত করে গবেষণায় পানির গুণগত মানের মাসভিত্তিক পরিবর্তন ও ভারী ধাতুর ঘনত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সে সময় ক্ষতিকর ধাতু, অ্যামোনিয়া, মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। অন্যদিকে জানুয়ারিতে জৈব দূষণ সর্বোচ্চ থাকে। বর্ষার শুরুতে জৈব দূষণ কিছুটা কমলেও এ সময় পানিতে বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, নদীর পাড়ের মাটি সবচেয়ে বেশি দূষিত হয় অ্যালুমিনিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, ব্যাটারি থেকে নির্গত লিথিয়াম ও বিভিন্ন অব্যবহূত রাসায়নিক, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদির দ্বারা।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন পরিষেবার ঘাটতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের বেশির ভাগ সরকারি বা অন্যের পতিত জমিতে বসতি স্থাপন করে বাস করে। খুব কমসংখ্যক মানুষের নিজস্ব জমিতে বসতি রয়েছে। সরকারি জমিতে বসবাসরতরা সবসময়ই উচ্ছেদের ঝুঁকিতে থাকে। এসব পরিবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে স্থাপিত নলকূপ ও ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) সরবরাহকৃত সীমিত পরিসরের পানির ওপর নির্ভরশীল। টঙ্গী খালের দক্ষিণ তীরে বসবাসকারীরা বৈধ বা অবৈধভাবে ওয়াসার পানি প্রাপ্তির সুবিধা পেলেও উত্তর পাড়ের বাসিন্দারা কমিউনিটিভিত্তিক নলকূপের ওপর নির্ভরশীল। হাঁটার দূরত্বে উন্নত পানির উৎস থাকলেও পানি নির্দিষ্ট সময় পাওয়া যায়। এ পানি পান করা বা রান্নার জন্য নিতে হলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। টঙ্গী খালপাড়ের বাসিন্দাদের ৬৮ শতাংশ ন্যূনতম পাঁচ পরিবার একই উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে। বাকিরা তারও বেশি পরিবার একসঙ্গে পানি সংগ্রহ করে।
থালা-বাসন ও কাপড় ধোয়া, মাছ ও শাকসবজি পরিষ্কারের মাধ্যমে নদীর পানি সরাসরি ব্যবহার করে বাসিন্দারা। শুধু দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াসার পানির সরবরাহ থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য সময়ের কাজের জন্য তাদের নদীর ওপর নির্ভর করতে হয়। আগে সময় কাটাতে বা মনের আনন্দে নদীতে সাঁতার কাটার যে বিষয়টি ছিল সেটি এখন আর নেই। কারণ দূষণের কারণে ও পানির স্বল্পতায় নদীতে বেশির ভাগ সময় সাঁতার কাটার পরিস্থিতি থাকে না। ফলে স্থানীয়দের নদীকেন্দ্রিক যে মিথস্ক্রিয়া ছিল, তা কমে গিয়েছে। নদীতে মাছ শিকারের সুযোগ কমে যাওয়ায় স্থানীয় অনেক নারী-পুরুষ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের পেশায় নেমেছে। অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারীরা নৌকায় করে নদীতে ঘুরে ঘুরে প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে।
সরজমিনে টঙ্গীতে তুরাগ নদের পাড়ের অন্তত ১০০ গৃহস্থালির তিনটি বসতি ঘুরে দেখা যায়, নদীর দূষণের ফলে বাসিন্দারা জীবনযাত্রাকে সংকুচিত ও পেশার পরিবর্তন করেছে। তাদেরই একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব নুরুল ইসলাম। অতীতে এ নদীতে মাছ শিকার করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তার উপার্জনের মাধ্যম রিকশা চালানো।
নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের বেশির ভাগেরই নেই স্বতন্ত্র টয়লেটে। আবার বেশির ভাগ টয়লেট সেপটিক ট্যাংকসহ ফ্লাশ ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব স্থান থেকে মানবদেহের বর্জ্য সরাসরি নদীতে মিশছে। গৃহস্থালির কাজের জন্য নারীরা সেই দূষিত পানিই বেশি ব্যবহার করছেন। নিরাপদ পানি ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই দূষিত পানি ব্যবহার করতে হয়। যেমনটি দেখা যায় চল্লিশোর্ধ্ব আকলিমা বেগমের ক্ষেত্রে। নদীর পাড় ঘেঁষে স্থাপিত ঝুলন্ত টয়লেটের পাশেই তার রান্নার ব্যবস্থা। আবার রান্নার জন্য ব্যবহার করছেন সেই নদীরই পানি।
গবেষক দলের সদস্য এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবেদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, পানিদূষণের যে জায়গাগুলোতে আমাদের কাজের ক্ষেত্র ছিল, সেসব জায়গার বাসিন্দা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ। যারা নদীর পাশে বসবাস করে না, তাদের চেয়ে এদের স্বাস্থ্য ব্যয়টা কিছুটা বেশি। সরকার বর্তমানে নদী দখলমুক্ত ও দূষণ রোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ফলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু নদীদূষণের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে তা গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। মূলত নিরাপদ পানির অভাবই এ বৈষম্যের কারণ। বাসিন্দাদের মধ্যে নারীরা বেশি ভুক্তভোগী। দূষণের কারণে নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি পরিবর্তন হয়েছে, তৈরি হয়েছে স্বাস্থ্যগত জটিলতা।
নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে নদী, জলাভূমি, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিলকে কেন্দ্র করেই বহু মানুষের জীবিকা ও বাণিজ্য চলে। এসবের পানি ও মাটি দূষণের ফলে সামাজিক ক্ষতি মারাত্মক। নদীকে কেন্দ্র করে এখন বৈষম্য হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. হাসান এ শাফী বণিক বার্তাকে বলেন, নগরায়ণের ফলে সামাজিক অনেক কর্মকৌশলের পরিবর্তন হয়েছে। নগরায়ণ নদীতীরবর্তী মানুষদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারেনি। অপরিশোধিত বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করেছে। ফলে নদীকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে নদীর ওপর নির্ভরশীল গোষ্ঠীগুলো বঞ্চিত হয়েছে। নগরায়ণের ফলে নগরীর বাসিন্দাদের সুবিধা বাড়লেও নদীতীরবর্তী মানুষের সুবিধা কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে তাদের জীবিকার ওপর। নদীদূষণের ফলে তীরবর্তী বাসিন্দারা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে পড়েছে তা আমাদের নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার ওপারে কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী ও রূপগঞ্জের জায়গাগুলোর বাসিন্দারা আরো ক্ষতিগ্রস্ত। এখানে মত্স্যজীবী নেই বললেই চলে। অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারা শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে ভুগছেন। নদীর অপর পাড়ের জনগোষ্ঠীরা যে পানিতে গোসল করত, ফুটিয়ে খেত তা এখন পারছে না। নদীর পাড়ের শিশুরা সাঁতার জানে না। কেননা তারা সাঁতার শেখার সুযোগ পায়নি। সেচকাজে পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এতে তীরবর্তী মানুষের কৃষিনির্ভরতা কমেছে। অনেকেই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেন। ফলে স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নামছে। বৃষ্টির মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির অভাব পূরণ (রিচার্জ) হয়। তবে শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গায় তা হচ্ছে না। রিচার্জের অন্যতম জায়গা ছিল রিভার বেড বা নদীর তলদেশ। তাতে পলিথিনের স্তর পড়ে যাওয়ায় রিচার্জ হতে পারছে না।
দূষণের কারণে নদীতীরবর্তী মানুষ বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান খায়রুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমরা কয়েক বছর আগে এমন একটি গবেষণা করেছিলাম। তখন সাভার ইপিজেডের বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা (ইটিপি) ছিল না। ফলে বর্জ্য বংশী নদীতে পড়ত। ওই নদীকেন্দ্রিক জেলেপাড়া বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। জেলেরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। দূষণের কারণে নদীকেন্দ্রিক জীবিকা বিলুপ্ত হয়েছে। মাঝি হোক বা জেলে অথবা নদীতীরবর্তী চাষী হোক তাদের পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। কয়েক দশক আগে নদীগুলোতে সাঁতার কাটা গেলেও তা এখন সম্ভব হচ্ছে না। শুধু পানি না পাওয়ার কারণে নিম্নবিত্তরা আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এসব বিষয়ে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, নদীর দূষণ বন্ধে আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। জেলা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নদীরক্ষা কমিশনের কমিটি রয়েছে। কমিটিগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে নদীদূষণ ও নাব্যতার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক কমিটির আহ্বায়ক। আমরা তাদের উৎসাহিত করছি কোথায় কোথায় দূষণ আছে, দূষণের উৎস কী, কী করা উচিত, আইনের কোন ধারা তারা ব্যবহার করতে পারবেন এসব বিষয়ে। পরিবেশ আইনের প্রয়োগ করবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। নদীতীরবর্তী মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বৈষম্যের শিকারও হচ্ছেন। আমরা জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) সঙ্গে কাজ করব। দূষিত নদীর দুই পাড়ের মানুষের রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হবে। শুধু নদী রক্ষা করলে হবে না। নদীপাড়ের বাসিন্দাদের রক্ষা করতে হবে। নদীর সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে।