ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতাল: অপারেশন থিয়েটারে তালা, মেলে না বিশেষায়িত সেবা

পুরান ঢাকার চকবাজারে আজ থেকে বছর ৩০ আগে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া শুরু করে ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতাল। তবে শুরু থেকেই পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালিত এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। বর্তমানে লোকবল ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় ১০০ শয্যা থেকে সেবার পরিধি ৫০ শয্যায় নামিয়ে আনা হয়েছে। অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। একই সঙ্গে সিলগালা করে রাখা হয়েছে পুষ্টি, নবজাতকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড। ফলে বিশেষায়িত চিকিৎসা তো দূরে থাক, জরুরি বিভাগে প্রাথমিক সেবা পেতেও যেন পদে পদে বিড়ম্বনা।

চারতলা ভবনে স্থাপিত হাসপাতালের নিচতলায় রয়েছে বহির্বিভাগ, ডিউটি নার্স স্টেশন, টিকাদান কেন্দ্র, ডিসপেনসারি, ওয়ার্ড মাস্টার, রোগীদের জন্য রান্নাঘর। তবে এসব কক্ষের প্রায় অর্ধেক অবকাঠামোই ব্যবহারের অনুপযোগী। তাই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। দ্বিতীয় তলায় পরিচালক ও হাসপাতালের কার্যালয়, ফিজিওথেরাপি সেন্টার, রেডিওলজি ও প্যাথলজি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার ও কেবিন ব্লক। এর মধ্যে কেবিনগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। সিলগালা করে রাখা হয়েছে অপারেশন থিয়েটারও। অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ধুলায় ঢাকা অপারেশন থিয়েটার এবং কেবিন ব্লকের বারান্দার চিত্রই জানান দেয়, দীর্ঘ সময় ধরে সে পথে পা রাখেনি কেউ। তৃতীয় তলায় রয়েছে মেডিসিন, ডায়রিয়া, ডেঙ্গু ওয়ার্ড, জরুরি বিভাগ, চিকিৎসক ও নার্সদের কক্ষ, নিউট্রিশন (পুষ্টি) এবং নিওনেটাল (নবজাতক) ওয়ার্ড ও কিছু কেবিন। তবে ওয়ার্ড ও কেবিনগুলো পড়ে আছে সিলগালা অবস্থায়। হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলার পুরোটাই তালাবদ্ধ, যেটা একসময় চিকিৎসকদের আবাসিক হিসেবে ব্যবহূত হতো। সব মিলিয়ে ভবনের সিংহভাগই এখন আর ব্যবহার হচ্ছে না। আসবাবগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত। প্রতিটি তলায় থাকা শৌচাগারের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে সেখানে গেলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিচালিত সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের চিত্রই প্রায় এক। যেন আইসিইউর মধ্যে কোনো রকমে টিকে আছে! চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় লোকবল ও আনুষঙ্গিক সুবিধার বালাই নেই। চিকিৎসা সরঞ্জামও নেই তেমন একটা। সব মিলিয়ে এসব হাসপাতাল কোনোকালেই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিতে পারলেও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগে কর্তৃপক্ষের সুযোগ কম। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে চিকিৎসক ও নার্স নিতে হচ্ছে। যন্ত্রপাতির সহায়তাও নেয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেই।

ডিএসসিসি ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে ১০০ শয্যার হাসপাতালটির সেবার সক্ষমতা ৫০ শয্যায় কমিয়ে আনা হয়েছে। চিকিৎসকের ২২টি পদের বিপরীতে রয়েছেন কেবল ১৩ জন এবং ৩০ নার্সের জায়গায় কাজ চালানো হচ্ছে সাতজনকে দিয়ে। আর ১৩০টি চতুর্থ শ্রেণীর পদের বিপরীতে রয়েছেন ৭৬ জন। তাদের অনেকেই আবার কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে। হেলথ টেকনোলজিস্ট, কনসালট্যান্ট, অ্যানেসথেটিস্ট (অবেদনবিদ) ও মেডিকেল অফিসারের অর্ধশতাধিক পদ দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য। লোকবলের এ সংকটের কারণেই বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড ও অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিকিৎসক ও নার্স সংকট থাকায় নিচতলা থেকে সরিয়ে জরুরি বিভাগ নেয়া হয়েছে তৃতীয় তলায়। তবে সেখানেও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার বেশ ঘাটতি। অনেক সময় পাওয়া যায় না প্রাথমিক চিকিৎসাও। কোনো সাধারণ দগ্ধ, কাটা-ছেঁড়া রোগী এলে তাদের জরুরি সেবা দেয়ার সুবিধা নেই। সার্জারি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ না থাকায় প্রায় ১৪ বছর ধরে হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচার হয় না। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকায় রোগ পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোয়ও পড়েছে ধুলোর আস্তর। চিকিৎসা সুবিধার জন্য কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সিটি স্ক্যান), ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই), আল্ট্রাসনোগ্রাফির মতো গুরুত্বপূর্ণ রোগ নিরীক্ষা পদ্ধতিও এখানে নেই। রেডিওলজির রোগ নিরীক্ষা বলতে কেবল এক্স-রে করা হয়। আর প্যাথলজির মধ্যে মেলে কেবল নয়টি সাধারণ পরীক্ষা। যন্ত্রপাতি ও লোকবল সংকট থাকায় বিশেষায়িত ও সূক্ষ্ম পরীক্ষা হয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স বণিক বার্তাকে বলেন, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ হাসপাতালে আছি। সময়ে সময়ে কেবল নতুন পরিকল্পনার কথা শুনি কিন্তু বাস্তবায়ন দেখি না কখনই। হাসপাতালটি এখন যেন গুদামঘরে পরিণত হয়েছে। নার্সেস স্টেশনে একটু হাত ধোয়ারও ব্যবস্থা নেই। অথচ আমরা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে কাজ করি। সব মিলিয়ে কোনো মতে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন আমিনা খাতুন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কেউ ইচ্ছা করে হাসপাতালে আসে না। ছেলের ডায়রিয়া হয়েছে তাই এসেছি। তবে আর কখনো এ হাসপাতালে যেন আসতে না হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা নিতেও পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ।

হাসপাতালের নিউট্রিশন, নিওনেটালসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড বন্ধ রয়েছে। তবে চালু থাকা মেডিসিন ওয়ার্ডেও মিলছে না বিশেষায়িত সেবা। এ ওয়ার্ডে মূলত নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সংক্রমণ, ঠাণ্ডা-কাশি, টাইফয়েডের চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা না থাকায় নিউমোনিয়াসহ মারাত্মক রোগের জটিল চিকিৎসা মেলে না। শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) অবকাঠামোও নেই হাসপাতালটিতে।

এমন পরিস্থিতির জন্য সরকারের ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এ অক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। শিশুদের চিকিৎসাসেবা দেয়া এ হাসপাতালটির যে অবস্থা, তাদেরকে (সিটি করপোরেশন) এখনই সেটিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিত। নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়ও স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, হাসপাতালটিকে ১০ তলা করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে দরপত্র আহ্বানের কার্যক্রমও পরিকল্পনাধীন। মেরামত করা হবে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও। সংস্কার করা হবে দেয়ালের খসে পড়া পলেস্তরা। সংকটের মধ্যেও জনসাধারণকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আহমেদ কুদরতে খোদা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, লোকবলের সংকট সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। সার্জারি বিশেষজ্ঞ ও অ্যানেসথেটিস্টও নেই। তাই অস্ত্রোপচারের কোনো সুযোগ নেই আমাদের এখানে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছেন। বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ২৫০ রোগী আসছেন। তবে হাসপাতালের সেবার পরিসর বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সের কিছুটা সংকট রয়েছে। তাই অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। তবে নার্স নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একসঙ্গে ৪৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে। তাছাড়া নিজেদের চিকিৎসকের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রেষণে চিকিৎসক আনা হয় এখানে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আরো চিকিৎসক দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হাসপাতালের প্রথম থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত দ্রুতই সংস্কার করা হবে। সব হয়ে গেলে পরিপূর্ণভাবেই শুরু করা যাবে চিকিৎসা কার্যক্রম।

Source: Bonik Barta

Share the Post: