তিন বছরে শিশুমৃত্যুর হারে উন্নতি নেই

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা রাঙ্গামাটিতে সাত লাখ মানুষের বাস। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা এ জেলায় শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে বছরে ৪৪ থেকে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। একই অবস্থা বান্দরবান, শরীয়তপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে। মূলত প্রসূতিসেবার দুষ্প্রাপ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণে অনাগ্রহ, অবকাঠামোগত যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সামাজিক সুরক্ষার অভাবের কারণেই এ জেলাগুলোতে শিশুমৃত্যুর হার বেশি।

২০ বছরে শিশুমৃত্যুর তথ্যের তুলনা করলে দেখা যায়, আগের চেয়ে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। তবে তিন বছর ধরে এ খাতে কোনো উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭। তিন বছর ধরে যার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি হাজারে এক বছরের কম বয়সী ২২ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৯ ও ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১ জন করে। প্রতি এক হাজার নবজাতকের (২৮ দিন) মধ্যে ২০১৮ সালে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। পরের দুই বছর এ সংখ্যা ছিল ১৫। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে এক থেকে ১১ মাস বয়সী প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২৮ জন করে মারা গেছে।

মূলত জন্মের সময় শ্বাসরুদ্ধ হওয়া, জীবাণুর আক্রমণ, সংক্রামক রোগ ও কম ওজনের মতো প্রতিরোধযোগ্য কিছু কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়। শতকরা ৫৩ শতাংশ ১ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যায় ঠাণ্ডাজনিত কারণে। ৯ শতাংশের মৃত্যু ঘটে জন্মকালীন শ্বাসরোধে। অপুষ্টির কারণে ৯ শতাংশের বেশির মৃত্যু হয়। এছাড়া বড় একটি সংখ্যার মৃত্যু হয় অপরিণত জন্ম ও জন্মের সময় কম ওজন হওয়ার কারণে। ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ আরো চারটি কারণে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছরের শিশুদের মৃত্যুর কারণও ঠাণ্ডাজনিত। পানিতে ডুবে মারা যায় ৯ শতাংশ, শ্বাসপ্রদাহজনিত রোগে ৮ শতাংশ, অপুষ্টিতে ৬ শতাংশ, জন্ডিসে ৪ শতাংশ ও জটিল ডায়রিয়ায় ৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। দেশে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। জন্মানোর সময় তাদের ওজন থাকে আড়াই কিলোগ্রামের কম। এ শিশুদের শরীরে তাপ থাকে কম। বুকের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তিও কম থাকে। এসব নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শিশুমৃত্যুর সঙ্গে চিকিৎসা ও প্রসূতিসেবার পাশাপাশি সামাজিক বিষয় বা সুরক্ষাও জড়িত। শিক্ষাগত যোগ্যতা, মায়ের বয়স, পুষ্টি ও জীবনাচারের ঘাটতি থাকলে তা শিশুমৃত্যুর হারকে প্রভাবিত করে। দেশে এখনো কিশোরীদের (১৫ থেকে ১৯ বছর) গর্ভধারণ আশানুরূপ কমানো যায়নি। ফলে কিশোরী মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া শিশুদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সন্তান গর্ভধারণের আগে থেকে প্রসবের সময় পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শের মধ্যে আসাকে প্রসবপূর্ব সেবা বা অ্যান্টিন্যাটাল কেয়ার (এএনসি) বলা হয়। এতে গর্ভের সন্তান চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকে। নিয়মিত নিরীক্ষা করা হয়। ফলে প্রসবের সময় কোনো ধরনের জটিলতা তৈরির শঙ্কা কম থাকে। সরকারের এ অধিদপ্তর সাধারণত প্রতি প্রসূতিকে চারবার এ সেবা দিয়ে থাকে। যদিও এ সেবা আটবার হওয়া উচিত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ রয়েছে।

বিবিএস বলছে, দেশে ৪৪ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হয়। ২৮ শতাংশ হাসপাতালে, ২৬ শতাংশ ক্লিনিকে এবং মা ও শিশু হাসপাতালে ২ শতাংশ প্রসব হয়ে থাকে। তবে প্রসূতি সেবার জন্য দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি থাকলেও নার্স ও প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাব রয়েছে। বাড়িতে প্রসবের সময় ৪১ শতাংশ চিকিৎসক, ১২ শতাংশ নার্স ও ধাত্রী, ১৪ শতাংশ প্রশিক্ষিত ধাত্রী, ২ শতাংশ প্যারামেডিক ও পরিবার কল্যাণ কর্মী এবং ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রাম্য ধাত্রীর সেবা পান প্রসূতিরা। দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ কিশোরীদের গর্ভধারণ। দেশে বাড়িতে সন্তান জন্মদানকারী মায়েদের ৭৩ শতাংশই কিশোরী। কিশোরীদের গর্ভধারণের ফলে মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়িতে প্রায় ৯০ শতাংশ প্রসব অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর হাতে হচ্ছে। ফলে মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জন্ম নেয়া শিশুদের বেশির ভাগেরই জন্ম হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বেশি করছে।

পরিসংখ্যান বলছে, পঞ্চগড়ে প্রতি হাজারে ৪৭ থেকে ৬৪ শিশুর মৃত্যু হয়। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক প্রসূতিসেবা না নেয়ার ফলে শিশুমৃত্যুর হার বেশি বলে জানিয়েছেন জেলাটির সিভিল সার্জন ডা. মো. ফজলুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ এ জেলায় নবজাতকের মৃত্যু বেশি। এখানের প্রসূতিরা হাসপাতালে প্রসূতিসেবা নেন না। প্রসবের সময় তারা বাড়িতেই থাকেন। এতে অদক্ষ হাতে সন্তান জন্ম নেয়। ফলে জেলায় মৃত্যুর হার বেশি। তবে এ জেলায় অবকাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক সেবার ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তিনি। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও সেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেয়ার পরিমাণ বাড়ানো গেলে শিশুমৃত্যুর হার কমানো যেত বলেও মনে করেন এ কর্মকর্তা।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মা ও শিশু স্বাস্থ্য শাখা জানিয়েছে, বুকের দুধ টেনে খাওয়ায় অক্ষম শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালগুলোতে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) নামের সেবা কার্যক্রম চালু করেছে। এ পর্যন্ত ২২টি জেলায় এ সেবা চালু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশের সব জেলাকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে কাজ চলছে। সারা দেশে কেএমসির ৫০০টির বেশি কেন্দ্র চালু হবে। মূলত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে প্রসূতিদের সেবা দেয়া হয়। সারা দেশে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি বা প্রকল্প চলমান থাকলেও তা খুব বেশি মানুষের কাছে এখনো পৌঁছেনি। ফলে শিশুমৃত্যু হ্রাসের হারও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম মনে করেন, শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ জন্মগত সমস্যা। সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে প্রসব পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক সেবায় ঘাটতি থাকলে নবজাতকের জন্মগত সমস্যা দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুমৃত্যুর হার যে ক্রমধারায় কমার কথা ছিল, তা গত কয়েক বছরে কমেনি। নবজাতকের মৃত্যুর ফলে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হলে এ মৃত্যু কমানো যেত। আর নবজাতক ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর কারণ হলো অসচেতনতা ও সেবার অভাব। এখনো দেশের অনেক জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা হাজারে ৬০ জনের বেশি। এর কারণ হলো যথাযথ চিকিৎসা ও যোগাযোগের অভাব। এতে টিকাদান কার্যক্রম থেকে শুরু করে শিশুস্বাস্থ্যের জন্য সেবায় ঘাটতি থাকে। অপুষ্টির কারণেও অনেক শিশুর মৃত্যু হয়।

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ২০২১ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে ১৫-তে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নেয়া হয়েছিল। তবে এখন প্রতি এক হাজারে ২৮ জন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত সেবাদানকারীর সংকটের কারণে নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকের সংকট এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে করোনার কারণে গত দুই বছরে শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবায় অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারীর পুরো সময় নিয়মিত টিকা কার্যক্রম চালু রাখা হলেও মা-বাবারা তাদের শিশুদের টিকা দিতে কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাননি। ফলে টিকাদান কর্মসূচিতেও কিছু ধীরগতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে কিশোরীদের গর্ভধারণ তেমন কমানো যায়নি। শিশুমৃত্যুর এটিও বড় একটি কারণ।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, গত দেড় বছরে শিশুমৃত্যুর হার না কমার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে করোনা মহামারী। সংক্রমণের ভয়ে ব্যাহত হয়েছে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও প্রসূতি সেবা। ফলে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: