মানুষের চাপে করিডোরে জোরে হাঁটা দায়। গাইনি, ক্যাজুয়ালটি, অর্থোপেডিকসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে চেঁচামেচি। যেখানে-সেখানে অবলীলায় পানের পিক, থুথু ফেলছে মানুষ। তারা সবাই দর্শনার্থী অথবা বহিরাগত। নভেল করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগকেও থোড়াই কেয়ার করছেন তারা।
দেশের বৃহত্তম সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের চিত্র এমনই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা জারির এক বছরেও দর্শনার্থী ব্যবস্থাপনায় কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। দর্শনার্থীর চাপে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে স্বীকার করছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও, রয়েছে সংক্রমণ ঝুঁকিও।
গত বছরের ১২ জানুয়ারি সরকারি হাসপাতালে দর্শনার্থী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। নির্দেশনার ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ও নিরাপদ চিকিৎসা দিতে হলে রোগীর সঙ্গে আসা দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। দর্শনার্থীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক অভিজ্ঞতা এবং জীবাণু সংক্রমণ রোধে করণীয় বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাবে অধিকাংশ সময় কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ বা পরিস্থিতির অবনতি হয়। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত দর্শনার্থী হাসপাতালে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, ইউটিলিটি সার্ভিস, রোগীর গোপনীয়তা এবং চিকিৎসাসেবীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে।
চিঠিতে মন্ত্রণালয়ের আট দফা নির্দেশনায় প্রত্যেক হাসপাতালে দর্শনার্থী পাস চালু এবং প্রতিটি পাসের জন্য নিরাপত্তা জামানত চালু; রোগীর অসুস্থতা বিবেচনায় একজন রোগীকে সহায়তার জন্য সর্বোচ্চ দুজন দর্শনার্থীকে পাস দেয়া; হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের পরিচয়পত্র দৃশ্যমানভাবে ঝুলিয়ে রাখা; দর্শনার্থীদের জন্য পাস ইস্যু করার সময় নাম, ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর, পরিদর্শনের কারণ ইত্যাদি তথ্য সংবলিত রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করা; দর্শনার্থী/ব্যক্তির হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির ব্যবস্থা করা, দর্শনার্থী বিষয়ক নিয়মাবলি রোগী ও রোগীর সহায়তাকারীদের অবহিত করা এবং এসব নিয়মাবলি সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখার কথা বলা হয়।
রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতাল, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে মন্ত্রণালয়ের এসব নির্দেশনার ন্যূনতম বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
হাসপাতাল চত্বরের পাশাপাশি ওয়ার্ডেও দর্শনার্থীদের ভিড়, হকার, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী, ভবঘুরে, ভিক্ষুকসহ নানা শ্রেণীর মানুষের অবাধ যাতায়াত লক্ষ্য করা যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, লোকবল ও অর্থ সংকটের কারণে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. তাপস কুমার সরকার বলেন, লোকবলের অভাবে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে রোগী আসেন দেড় থেকে দুই হাজার। গড়ে প্রতিদিন দর্শনার্থী থাকেন তিন হাজারের বেশি। নির্দেশনা বস্তবায়ন করার জন্য অর্থ ও লোকবল বরাদ্দ চাওয়া হলেও দেয়নি মন্ত্রণালয়।
নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে একই সমস্যার কথা বলেন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোখলেসুর রহমান ও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সাজিদ হোসেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন ৬ দশমিক ৭৩ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় চিকিৎসকের সংখ্যা ১ দশমিক ৫৫ জন। আর সমসংখ্যক মানুষের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৬০ জন।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিডিএমসি) হিসাবে, দেশে রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে সরকারি হাসপাতালে দর্শনার্থী ঠেকাতে কোনো নির্দেশনা কাজে আসবে না। দর্শনার্থীদের অবাধ যাতায়াত রোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলছেন, ১০০ শয্যার হাসপাতালে প্রায় ২০০ রোগী ভর্তি থাকেন। এর মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ দর্শনার্থী এলে পানির সংকট, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে নানা সংকট দেখা দেয়। এছাড়া আগতরা কোনো না কোনো জীবাণু বহন করেন। ফলে হাসপাতালে উল্টো রোগের ঝুঁকি বাড়ে। বাতাসও ভারী হয়ে যায়। দর্শনার্থীদের চাপে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবাও ব্যাহত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ বলেন, হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়া আমাদের দেশে একটা সামাজিক রীতি। বিষয়টি থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবায় লোকবলের সংকট রয়েছে। খাওয়া, পোশাক পাল্টানো থেকে সব বিষয়ে রোগীকে নিজস্ব লোকের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারি হাসপাতালে অনেক পরীক্ষা হয় না। বাইরে থেকে করাতে হলে বাড়তি লোকের প্রয়োজন পড়ে। স্বাস্থ্যসেবাটা পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। সেটাকেও ফিরিয়ে আনতে হবে।
দর্শনার্থী ব্যবস্থাপনা বেশ জটিল কাজ উল্লেখ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসাসেবায় লোকবলের সংকট রয়েছে। দর্শনার্থীদের বিরত রাখতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে লোকবলের সংকট নিরসন জরুরি বলে স্বীকার করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া। তিনি আরো বলেন, সামাজিকভাবে আমরা সচেতনও নই। কোনো রোগীকে দেখতে যাওয়া যে উচিত নয় এমন ধারণাই আমাদের দেশে নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি।