সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের আখড়াখোলা কমিউনিটি ক্লিনিক। ২০০১ সালে স্বল্প খরচে নির্মিত ক্লিনিকটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ। ভারি বৃষ্টিতে ছাদ থেকে চুইয়ে পানি পড়ে। এতে তলিয়ে যায় পুরো মেঝে। দুই কক্ষ, এক বারান্দা ও দুটি শৌচাগারবিশিষ্ট ভবনের দেয়াল থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা। ভেঙে গেছে দরজা ও জানালা। শুধু এ ক্লিনিকই নয়, দেশে ১০ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিকের আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে। জরুরি হয়ে পড়েছে পুনর্নির্মাণ। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ড এরই মধ্যে সাত-আট হাজার ক্লিনিক পুনর্নির্মাণের জন্য সরকারকে সুপারিশ করেছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৪১টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। শুরুর দুই বছরে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয় স্বল্প ব্যয়ে। এসব ক্লিনিকের আয়ুষ্কাল প্রায় শেষ। এর মধ্যে সাত-আট হাজার ক্লিনিক পুনর্নির্মাণে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে।
ট্রাস্টি বোর্ডের সাম্প্রতিক এক সভায় কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) লাইন ডাইরেক্টর জানান, সারা দেশে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে প্রায় সাত-আট হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পুনর্নির্মাণ জরুরি। নির্মাণকাজের পরিসর বড় হওয়ায় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এদিকে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের জন্য ৮৪টি দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রেখেছে। ৭৬৪টি ক্লিনিকের পুনর্নির্মাণ শেষ হয়েছে। আর চলমান রয়েছে ৪০টির কাজ। আরো কিছু ক্লিনিক পুনর্নির্মাণের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়াধীন।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কক্সবাজারে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) মাধ্যমে ১০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক পুনর্নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১৪টির কাজ চলছে। তবে এসব বিষয় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ডকে বা বোর্ডের সভাপতিকে কখনো জানানো হয়নি। ফলে এ নিয়ে সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
সভায় কমিউনিটি ক্লিনিকের সার্বিক অবস্থা জানার জন্য সারা দেশের ক্লিনিক ভবন ও জনবলের সফটওয়্যার-ভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত অবস্থার তথ্যাদি সংগ্রহ করে দ্রুত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো, পুনর্নির্মাণ কাজে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।
কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গ্রামাঞ্চলের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করে সরকার। এ সময় মোট সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করার পরিকল্পনা রাখা হয়। শুরু থেকেই প্রকল্পটিতে জনগণের অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে এলাকাবাসীর দান করা জমিতেই ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমটি গুরুত্ব হারায়। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পুনরায় সেবা প্রদানের উপযোগী করার জন্য পাঁচ বছরমেয়াদি একটি ‘পতাকাবাহী’ প্রকল্প দ্বিতীয়বারের মতো হাতে নেয়া হয়।
এদিকে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ হাজার ৬২৪টি ক্লিনিকের সংস্কার ও ২ হাজার ৭৫৯টি নতুনভাবে নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে নির্মিত ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিকের মধ্যে ১০ হাজার ৬২৪টি মেরামত করে সেবা প্রদানের উপযোগী করা হয়। একই সঙ্গে হাওর, বাঁওড়, পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় ২ হাজার ৭৩৭টি ক্লিনিক নতুন নির্মাণ করা হয়। ফলে মোট ১৩ হাজার ৩৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রকল্পের আওতায় সেবা প্রদানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় ১৩ হাজার ৩৬১টি। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জনের হার ৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এসব ক্লিনিক ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়।
তাতে কী নির্মাণ সামগ্রী দেবে, আর কী নির্মাণ করবে। দুর্ভাগ্যবশত এ নির্মাণ বরাদ্দটাই ভুল ছিল। এসব ক্লিনিক পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময় ৬-৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত করা হয়। তখন দুই কক্ষের জায়গায় এখন চার কক্ষের ক্লিনিক নির্মাণ করা হবে। আগের চেয়ে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে আরো সুন্দর করা হবে।
তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়গুলো ট্রাস্টকে অবহিত না করে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলো নিজেদের মতো করে কাজ করছিল। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছি। ট্রাস্টের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাকেও বিষয়গুলো জানিয়েছি। আশা করি এখন সমস্যাগুলো থাকবে না। সরকারি লোকদের সমন্বয়হীনতার বিষয় কিন্তু মানুষের বোঝার কথা নয়। তারা সেবা চায়। ভালো সেবা দিতে চাই। যেসব লোক কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করে, তাদের আরো প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। লোকবলও বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, কমিউনিটি ক্লিনিকে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সেবা দেয়া হয়। প্রতিটিতে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (সিএইচসিপি), একজন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) থাকেন। এসব ক্লিনিক মাতৃত্বকালীন, গর্ভকালীন ও প্রসূতি সেবা, শিশুদের যাবতীয় রোগের সমন্বিত চিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), নবদম্পতিদের রেজিস্ট্রার, গর্ভবতী মা, জন্ম-মৃত্যু, প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ (ইডিডি) নিবন্ধীকরণের কাজ করে। পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা ও পুষ্টিকর অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক শিক্ষা ও পরামর্শ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অটিজম ও ক্লাবফিট শনাক্তকরণ, জটিল রোগের জন্য উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রেফার করা, এলাকায় একটি কার্যকরী এমআইএস তথ্যের উৎস তৈরির সেবাগুলো প্রদান করা হয়।
সারা দেশে সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে পৌনে ১৪ হাজার বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। হিসাব অনুযায়ী, বিভাগভিত্তিক সবচেয়ে বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে চট্টগ্রামে। বিভাগটিতে ২ হাজার ৫৪৬টি ক্লিনিক রয়েছে। আর সবচেয়ে কম রয়েছে সিলেটে ৯০১টি ক্লিনিক। বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে ঢাকায় ২ হাজার ৪৬৬টি, রাজশাহীতে ১ হাজার ৯৬৫, রংপুরে ১ হাজার ৮৪৫, খুলনায় ১ হাজার ৬৩৬, ময়মনসিংহে ১ হাজার ২২০ ও বরিশালে ১ হাজার ৭৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব ক্লিনিকে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়েছে পৌনে ৫৮ হাজার, প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) দেয়া হয়েছে সাড়ে ৮৩ লাখ বার, প্রসবপূর্ব সেবা (পিএনসি) দেয়া হয়েছে সাড়ে ২৪ লাখ বার। আর ৮২ লাখ সেবাগ্রহীতাকে অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। এ চার বছরে প্রায় ৫১ কোটি বার সেবা নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে ১৬ লাখ মানুষের শরীরে প্রাথমিকভাবে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্ত করা হয়েছে।
তৃণমূল মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেই কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা হয় বলে মন্তব্য করেন কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। সারা দেশে আরো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে জানিয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক শুধু একটি ভবনই নয়। এ ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে মাতৃ, শিক্ষা, কৈশোর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা হয়। টিকাদান কর্মসূচি ও পুষ্টির কার্যক্রম চালানো হয়। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এসব ক্লিনিক থেকে সেবাগ্রহীতাদের পরবর্তী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে ২৭ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। ভিটামিন খাওয়ানো হয়। কাউন্সিলিং করা হয়।
সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। ছোট দেশে মানুষ বেশি। এখানে বরাদ্দের বিষয়টিও দেখতে হবে। মানুষ আরো সেবা চায়। সেবা বাড়াতে হবে। তবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে অনেক কাজ সঠিকভাবে হয় না। এখনো চুরি রয়ে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা আরো ঢেলে সাজাতে হবে। চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একদিনে এসব সম্ভব নয়।
পুনর্নির্মাণের আগে সঠিক পরিকল্পনা জরুরি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সুন্দরভাবে একটি পরিকল্পনা করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান ও পরিধি বাড়াতে হবে। পরবর্তী সময়ে এসব সেবা ও পরিধি বাড়ানো হলে বিদ্যমান অবকাঠামোয় হবে কিনা তা বিবেচনায় আনতে হবে। এমনভাবে ভবন নির্মাণ করতে হবে যেন আগামী কয়েক দশক এ ভবন দিয়ে কাজ চালানো যায়। নাহলে কিছুদিন পরপর নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়বে। একই সঙ্গে সব স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ড করা হয়েছে। ক্লিনিক নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সংস্কার, সেবার মান ও পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে সরকার কাজ করবে নাকি ট্রাস্ট কাজ করবে তা ঠিক করা উচিত। নইলে সমস্যা বাড়বে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের লোকবল বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, এখানে একজন প্যারামেডিক, নার্স ও ধাত্রী প্রয়োজন। অথবা সমমানের শিক্ষা যাদের আছে, তাদের নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। ধাত্রী নিয়োগ দিলে সে বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও প্রসূতির সন্তান প্রসব করাতে পারবেন। এক্ষেত্রে নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুর হার কমবে।