আধুনিক রোগ নির্ণয়কারী পরীক্ষা এমআরআই (ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স ইমেজিং)। মস্তিষ্কের এমআরআই করতে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে মূল্য ধরা হয় ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে একই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবার জন্য নানা অংকের মূল্য দিচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। সরকার নির্ধারিত মূল্য না থাকায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো উন্নত যন্ত্রাংশ ও সেবার কথা বলে ইচ্ছেমতো দাম হাঁকছে।
সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও ক্লিনিকের সেবার মূল্য তালিকা, ক্যাটাগরি ও চিকিৎসার সরঞ্জামাদির মানীকরণের জন্য কমিটিও করেছিল সরকার। দুই মাসের সময়সীমার কথা বলা হলেও কমিটি দেড় বছর পার করেছে। এর পরও সরকারকে কোনো সুপারিশ দিতে পারেনি কমিটি।
জানা যায়, ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (হাসপাতাল) সভাপতি ও যুগ্ম সচিবকে (বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা) সদস্য সচিব করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিকগুলোর সেবার মূল্য তালিকা, ক্যাটাগরি ও চিকিৎসার সরঞ্জামাদির মানীকরণের জন্য এ কমিটি গঠন করে সরকার। এজন্য কমিটিকে দুই মাসের সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়। কমিটি এ পর্যন্ত ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর একটি মাত্র সভায় মিলিত হয়েছিল। প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ হয়নি বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন।
কমিটির এ সদস্য জানান, প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের বর্তমান মূল্য তালিকা সদস্যদের দেয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের যন্ত্রাংশ রয়েছে তার তালিকাও দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কাগজে-কলমে কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, শুরুতে দেখতে হবে রাষ্ট্র স্বাস্থ্যসেবার মূল্য চূড়ান্ত করতে চায় কিনা। আগে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। এরপর হাসপাতালগুলোকে গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্যকে পণ্যের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে।
রাজধানীসহ দেশের তিনটি জেলা ও একটি বিভাগের অন্তত ১০টি হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, রোগ নির্ণয়ের একই পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন অংকের টাকা নেয়া হয়। এসব হাসপাতালগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য রোগীদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোর মূল্য তালিকা ও গ্রাহকসেবা কেন্দ্র বলছে, প্যারানাসাল সিনুস বা পিএনএসের কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফির (সিটি স্ক্যান) জন্য হাসপাতাল ভেদে ৮ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা নেয়া হয়। পেটের (হোল অ্যাবডমিন) কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফির জন্য নেয়া হয় ১২ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা।
সিজারিয়ান সেকশনের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে তিন-চারদিনের প্যাকেজ রয়েছে। ওয়ার্ড থেকে স্যুট পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যের প্যাকেজে ৬০ হাজার টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকার বিল করা হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল ভেদে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত ওষুধ দেয়া হয়।
মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইয়ারুল কবীর বণিক বার্তাকে জানান, কমিটি গঠনের পর মন্ত্রণালয় থেকে তাকে একটি চিঠি দিয়ে জানানো হয়। এরপর একটি সভাও হয়। তবে এরপর আর কোনো চিঠি তিনি পাননি। পরে কোনো কার্যক্রম সম্পর্কেও জানানো হয়নি।
তার মতে, রাজধানীর শীর্ষ বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান ও বিভাগীয় শহর বা জেলার বেসরকারি একটি হাসপাতালের সেবার মান এক হবে না। তাই যন্ত্রাংশ, সেবার মান ও লোকবলের ওপর নির্ভর করে এ, বি, সি, ডি এমন ভাগে দাম নির্ধারণ করতে হবে।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এএম শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, ভালো মানের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্য প্রায় একই ধরনের। সব হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যন্ত্রাংশ একই মানের নয়। হাসপাতালের যন্ত্রাংশ কত দাম দিয়ে কেনা, লোকবল ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সব হাসপাতালের যন্ত্রাংশ একই দাম ও ধরনের নয়। ঢাকার একটি ভালো মানের হাসপাতাল আর মফস্বলের একটি হাসপাতালের মান এক নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, রাজধানীর একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও মফস্বলের একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্যাটাগরি করার জন্য কাজ করছি। এরপর মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করা যাবে।