কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির আওতায় আগামী মাসে তৃতীয় দফায় আরো টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। এ দফায় ফাইজার-বায়োএনটেকের ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার কথা জানিয়েছে তারা। তবে অতিসংবেদনশীল এ টিকা সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত তাপমাত্রার আলট্রা লো ফ্রিজারের অপ্রতুলতা, পরিবহন ও বিতরণের বিষয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ৬০ লাখ ডোজ টিকা একসঙ্গে না দিয়ে কয়েক ধাপে পাঠাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোভ্যাক্সকে অনুরোধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সংকটের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা আসা শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা পেয়ে এরই মধ্যে আবারো সারা দেশে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এর মধ্যে টিকার জন্য গড়ে ওঠা বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির আওতায় এরই মধ্যে দুই দফায় দেশে টিকা এসেছে।
তবে তৃতীয় দফায় একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার ফলে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ সংরক্ষণ জটিলতা। সাধারণত আলো ও তাপে সংবেদনশীল ফাইজারের টিকা হিমাঙ্কের নিচে ৮০ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু দেশে এমন তাপমাত্রা উপযোগী নির্ধারিত আলট্রা লো ফ্রিজারের অপ্রতুলতা রয়েছে। যে কারণে এ টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা খুবই কম। একই সঙ্গে রয়েছে পরিবহন জটিলতা। যেজন্য রাজধানীর বাইরে এ টিকা প্রয়োগের সুযোগ নেই।
এর আগে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির আওতায় গত মে মাসে দেশে আসে ১ লাখ ৬০০ ডোজ ফাইজারের টিকা। আর এ ফ্যাসিলিটির আওতায় চলতি মাসের শুরুতে দেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা। এর মধ্যে মে মাসে আসা ফাইজারের টিকা বর্তমানে রাজধানীর সাতটি কেন্দ্রে প্রয়োগ চলছে।
সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সূত্রে জানা যায়, কোভ্যাক্স যে-সংখ্যক ফাইজারের টিকা দেয়ার কথা বলছে, তা একসঙ্গে সংরক্ষণের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। সরকারি বা বেসরকারি মিলিয়েও আলট্রা লো ফ্রিজারে এতসংখ্যক টিকা সংরক্ষণ করা যাবে না। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি), সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং কেন্দ্রীয় টিকা সংরক্ষণাগারে কিছু আলট্রা লো ফ্রিজার রয়েছে। যেখানে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে টিকা সংরক্ষণ করা যায়। তবে সব মিলিয়ে এসবের সক্ষমতা ১০ লাখের বেশি নয়।
ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা সংরক্ষণ জটিলতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা নতুন করে এ বিষয়ে পরিকল্পনা করছেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা কম। এ টিকা পেলে পরিকল্পনা করে তা রাজধানীর ভেতরেই হয়তো দেয়া হবে। সারা দেশে এর পরিবহন ও সংরক্ষণ সক্ষমতা নেই। একই সঙ্গে রাজধানীর বাইরে পরিবহন করা যাবে না। তবে কয়েক ধাপে এ টিকা পেলে সংরক্ষণ জটিলতা হবে না।
ইপিআইয়ের এক কর্মকর্তা জানান, টিকা আসার খবরে এখন বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে একসঙ্গে এত টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা নেই। ফলে কয়েক ধাপে এ টিকা পাঠানোর জন্য কোভ্যাক্সকে অনুরোধ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত জানুয়ারিতে জোটটির আট লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা দেয়ার কথা বলেছিল। সে সময় টিকা সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় আলট্রা লো ফ্রিজার কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে ফাইজারের টিকা না আসায় সে সময় এ উদ্যোগ থেমে যায়। এখন পর্যাপ্ত টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়ার পর আবারো ফ্রিজার কেনা ও আলট্রা লো কোল্ড রুম স্থাপনের বিষয়ে কথা হচ্ছে।
গত মে মাসে প্রথম দফায় ফাইজারের টিকা এলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ফাইজার ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম নামে কর্মপ্রণালি ঠিক করে। তাতে টিকা প্রয়োগের জন্য ব্যবস্থাপনা, টিকাদান কেন্দ্র, টিকাগ্রহীতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। টিকাদান কেন্দ্রে টিকা সরবরাহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার ও সতর্কতার বিষয়ে নির্দেশিকা উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগের সময় মিশ্রণের জটিলতায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রয়োগের আগে ডোজ প্রস্তুতের জন্য ডাইলুয়েন্ট নামের এক ধরনের মিশ্রণ যোগ করতে হবে। যেখানে সময় ও পরিমাণের হেরফের হলেই নষ্ট হবে এ টিকা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য আমাদের সক্ষমতা কম। এজন্য আমরা কোল্ড চেইন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক, ইউএনএফপিএসহ সহযোগী সংস্থাকে আলট্রা লো ফ্রিজার কেনার বিষয়ে সাহায্য চেয়েছি। একই সঙ্গে কোভ্যাক্সকে চিঠি দিয়ে কয়েক ধাপে ফাইজারের এসব টিকা দিতে অনুরোধ করেছি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফাইজার এবং জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘কমিরনাটি’ টিকা প্রয়োগের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা সুই-সিরিঞ্জের প্রয়োজন হয়। তবে হিমাঙ্কের নিচে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রয়োগের আগে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্যান্য টিকার মতো তাপমাত্রায় ফাইজারের টিকাও রাখা যায়। একটি ভায়ালের (শূন্য দশমিক ৪৫ মিলি) সঙ্গে মিশ্রণের পর টিকার ৬ ডোজ প্রস্তুত হবে। এমআরএনএ-ভিত্তিক জমে থাকা এ টিকা জীবাণুমুক্ত রেখে সংমিশ্রণ করতে হবে। টিকা আলট্রা কোল্ড ফ্রিজার থেকে বের করার পর ৬ ঘণ্টার মধ্যে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেখেই গলিয়ে ব্যবহার উপযোগ করতে হবে। দশমিক ৬ লিটার চারটি বরফব্যাগে করে টিকা বহনকারী বক্সে টিকাদান কেন্দ্রে নেয়া হবে। ডাইলুয়েন্ট মেশানোর আগে টিকার ভায়াল কক্ষের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট রাখতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন-গ্যাভি এবং সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে ১৯২টি সদস্য দেশ নিয়ে গড়ে ওঠে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি। জোটটি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য বিনামূল্যে টিকা সরবরাহ করবে। সেই হিসেবে এ ফ্যাসিলিটি থেকে বাংলাদেশের টিকার ডোজ প্রাপ্তির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটি ৮০ লাখে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ফাইজার ও মডার্নার ২৬ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছে।
এ পর্যন্ত দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী আটটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ টিকাগুলো হলো ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুতনিক-৫, চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না, বেলজিয়ামের জনসন অ্যান্ড জনসন এবং সুইডেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।