জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাংলাদেশে নিরাপদ পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আবার অনেক এলাকায় ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণও সহনীয় মাত্রার বেশি। একটি পরিসংখ্যান বলছে, কেবল রাজধানীতেই ভূগর্ভস্থ পানির অপরিমিত ব্যবহারের কারণে পানির স্তর প্রতি বছর প্রায় পাঁচ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সুপেয় ও নিরাপদ পানির একটি বিকল্প উৎস হতে পারে বৃষ্টির পানি। এজন্য সরকারের নানা উদ্যোগও আছে, কিন্তু সেসব এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা বছরের অন্য সময় ব্যবহারের পদ্ধতি বেশ পুরনো। সাধারণত বাড়ির ছাদ থেকে ছাঁকনির মাধ্যমে পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন পানির গভীর কুয়ায়) জমানো হয়। এরপর তা নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ৬৩ হাজারের কিছু বেশি লোকসংখ্যার ৫৩ বর্গকিলোমিটারের দেশ বারমুডা। দেশটির মানুষ মূলত সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করেই জীবন ধারণ করে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে খাবার পানি হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে তারা।
বাংলাদেশেও প্রায় ২৫ বছর আগে সুপেয় পানির জন্য এ পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ভূগর্ভস্থ পানি বা দূষণমুক্ত পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের জন্য সরকার বিভিন্ন মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেয়। কিছু প্রকল্প এখনো চলমান। কিন্তু দেশের গ্রাম বা শহরাঞ্চলে বৃষ্টির পানিকে (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং) খাবার পানি ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি। বরং পরিসংখ্যান বলছে, খাবার পানির জন্য বৃষ্টির পানির ব্যবহার কমে এসেছে। আর এজন্য অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি পানির এ উৎসকে জনপ্রিয় করতে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের কথা উঠে এসেছে।
চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে দেশে খাবার পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার নেমেছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশে। গ্রামাঞ্চলে খাবার পানিতে বৃষ্টির পানির উৎস কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ দাঁড়ালেও শহরে দাঁড়িয়েছে শূন্য শতাংশে।
বিবিএস বলছে, দেশে সাত ধরনের উৎস থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে বৃষ্টির পানিকে উৎস হিসেবে ব্যবহারের হার কমেছে। ২০১৮ সালে গ্রামাঞ্চলে খাবার পানির শূন্য দশমিক ৬ ও শহরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃষ্টির পানি থেকে আসত। ২০১৯ সালে এ হার কমে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ১ শতাংশে। ২০২০ সালে গ্রামাঞ্চলে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ খাবার পানি বৃষ্টি থেকে নেয়া হলেও শহরে তা শূন্যে নেমেছে।
খাবার পানি হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হতো খুলনা বিভাগে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বিভাগটিতে আড়াই শতাংশ খাবার পানির জোগান আসত বৃষ্টির পানি থেকে। ২০১৯ সালে এ হার ৩ শতাংশে দাঁড়ালেও ২০২০ সালে এসে তা কমে ১ শতাংশের নিচে দাঁড়িয়েছে। গত বছর পর্যন্ত বরিশালের কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা দিয়ে কাজ চালানো হয়। কিন্তু অন্য শহরগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরা হয় না বললেই চলে। অথচ বৃষ্টির পানি ধরে রাখা গেলে তা দিয়ে সহজেই একটি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা আশরাফ আলীর পরিবারের কথা উল্লেখ করা যায়। তার পাঁচ সদস্যের পরিবারের খাবার পানির প্রধান উৎস বৃষ্টির পানি। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দেশীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য এক হাজার লিটারের ট্যাংক বসিয়েছেন তিনি। বর্ষাকাল বাদে বাকি ছয় মাসের মধ্যে তিন থেকে চার মাসের খাবার পানির সংস্থান হয় এ ট্যাংক থেকে। বাকি দু-তিন মাস পার্শ্ববর্তী একটি ফিল্টার থেকে পানি কিনে পান করতে হয়।
তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, দেশের উপকূলীয় জেলায় প্রথমে শুরু হলেও পরে বিভিন্ন স্থানে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশে নিরাপদ খাবার পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ চলমান। বর্তমানে ৩০টির বেশি প্রকল্পে পৌর ও গ্রামীণ এলাকায় পানি, স্যানিটেশন, পয়োনিষ্কাশনসহ বেশ কয়েক ধরনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে দেড় হাজারের বেশি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং কূপ স্থাপন করার কাজ শেষ পর্যায়ে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ বৃষ্টি থেকে খাবার পানি সংগ্রহের কাজ করছে। চার থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের আরো একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) মো. আনোয়ার ইউসুফ।
কেবল খাবারের জন্য বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো যায় না বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য আমরা অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। বর্তমানেও চলমান রয়েছে। নতুন পরিকল্পনাও করা হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের মাত্র ৫ শতাংশ হলো খাবার পানি। গ্রামাঞ্চলে উপরিভাগের পানির স্তর সব সময় এক রকম থাকে না। তাই নলকূপ বা গভীর নলকূপ বসানো হয়। এতে সুবিধাভোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য যে অবকাঠামো দরকার তা নেই। গ্রামের বাড়িগুলো এলোমেলো। এক হাজার একরের কোনো গ্রামে বাড়িগুলো একই সারি বা এক স্থানে নয়, বরং এলোমেলো। অর্থাৎ বিদেশের মতো সাজানো নয়। এতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করলেও পাইপলাইন বসানো যায় না। একই সঙ্গে পাইপলাইন বসানো হলেও তাতে যে তদারকি ও ব্যবস্থাপনায় যে খরচ হয় তা গ্রামের মানুষ বহন করতে পারে না। যেসব স্থানে নলকূপ বসানো যায় না সেসব স্থানে বৃষ্টির পানির ব্যবস্থা করা হয়।
সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পানি সম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় গ্রাম ও শহরে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য কাজ করছে। চলতি বছরও দুটি প্রকল্প নেয়ার কথা বলেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দেশী ও বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দেশীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ পানিই জীবন নামে দক্ষিণাঞ্চলে একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। কয়রা, পাইকগাছা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার সমন্বয়কারী আবু সায়েম হোসেন বণিক বার্তাকে জানান, ২০১৭ সালে খুলনা-বাগেরহাট এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন তারা। এসব অঞ্চলে এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক সুবিধাভোগী তাদের সুবিধা ভোগ করেছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পানি, স্যানিটেশন ও পয়োনিষ্কাশন কর্মসূচি কমিটির সদস্য সচিব ড. তানভীর আহমেদ বলেন, শহর ও গ্রামের মানুষের পানি ব্যবহারের ক্ষেত্র এক নয়। কেবল খাবার পানির জন্যই নয়, অন্যান্য কাজের জন্য এ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। বৃষ্টির পানির ব্যবহার বেশ সহজও। কেবল সাধারণ ফিল্টার ব্যবহার করেই এ পানি পানের উপযোগী করা যায়। এজন্য বাড়তি কোনো রাসায়নিক বা প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না। এ উৎসকে জনপ্রিয় করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
জাতীয় পানি নীতিতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বিকল্প উৎসের কথা বলা হলেও বৃষ্টির পানির বিষয়ে তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল আলম। তিনি বলেন, উপকূলে লবণ পানি ও অন্যান্য অঞ্চলে আর্সেনিকের দূষণ রয়েছে। এতে নলকূপ বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে নলকূপের বিকল্প হিসেবে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং গুরুত্বপূর্ণ। শহরাঞ্চলের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং জরুরি। বহুতল ভবনের ছাদে এর ব্যবস্থা রাখার জন্য নতুন বিল্ডিং কোডে বলা হয়েছে। তবে এ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশে পরিচালক হাসিন জাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হলে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের বিকল্প নেই। তবে মানুষের কাছে অন্য উৎস থাকলে তারা স্বাভাবিক নিয়মেই বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল হতে চাইবে না। এজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের কাছে এর প্রয়োজনীয়তার কথা পৌঁছে দিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।