দেড় দশকে নগরে কিশোরী গর্ভধারণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

কিশোরী গর্ভধারণের পেছনে যতটুকু না জৈবিক কারণ হয়, তার চেয়ে বেশি প্রভাব থাকে আর্থসামাজিক কারণের। এমন গর্ভধারণ মাতৃ ও শিশুমৃত্যুকে প্রভাবিত করে। বাড়ায় অপুষ্ট নবজাতকের জন্মের হার। একটি দেশের সামষ্টিক স্বাস্থ্যগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে কিশোরী গর্ভধারণকে বড় বাধা হিসেবে ধরা হয়। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে কিশোরীদের গর্ভধারণ সবচেয়ে বেশি। এমন গর্ভধারণ কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশও তৈরি করতে পারেনি আশানুরূপ অবস্থান। নগরাঞ্চলে গত দেড় দশকে কিশোরীদের গর্ভধারণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এমন তথ্য উঠে এসেছে খোদ সরকারি জরিপে।

জরিপ বলছে, কিশোরী গর্ভধারণ (১৫-১৯ বছর) ও প্রারম্ভিক সন্তান জন্মদান মাতৃত্বের নেতিবাচক দিক। মূলত অনুন্নত আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে নগরাঞ্চলে কিশোরীদের গর্ভধারণ বা প্রারম্ভিক সন্তান জন্মদান আগের তুলনায় বেড়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) ‘আরবান হেলথ সার্ভে-২০২১’ কিশোরীদের গর্ভধারণের বিষয়টি তুলে ধরেছে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এ জরিপে নগরে অভিবাসন, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, প্রসূতি সেবাসহ নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়।

সরকারের ওই জরিপে শহর অঞ্চলের বস্তি, বস্তির বাইরে ও শহরের উপকণ্ঠের (পৌর এলাকা) বাসিন্দাদের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ১১টি সিটি করপোরেশনের বস্তি, বস্তির বাইরে ও পৌর এলাকার (যে এলাকায় ৪৫ হাজারের বেশি বাসিন্দা রয়েছে) তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মোট সাড়ে ৩৫ হাজার বাসিন্দাকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন ১২ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরী-নারী ও ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী কিশোর ও পুরুষ এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের তথ্য নেয়া হয়েছে।

কিশোরীদের গর্ভধারণের সঙ্গে করোনা মহামারীর একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন নিপোর্টের পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ আহছানুল আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌জরিপে কারণ দেখার সুযোগ ছিল না। আমাদের পর্যাবেক্ষণে মনে হয়েছে, করোনা মহামারীতে মানুষের চলাচল কম থাকায় গর্ভধারণ হতে পারে। জন্ম নিরোধক পদ্ধতি গ্রহণের হারও কমে গিয়েছিল। জরিপের তথ্য করোনাকালে সংগ্রহ করা হয়েছিল। অনুসন্ধান করতে পারলে নির্দিষ্ট কারণ উঠে আসত।’

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরণ বিতরণের হার কম ছিল। স্বাভাবিক সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক দম্পতির চেয়ে কিশোর দম্পতির মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার কম। নিপোর্টের জরিপ বলছে, নগরের বস্তি এলাকায় ২০২১ সালে জন্ম নিরোধক পদ্ধতি গ্রহণের গড় হার ৭২ শতাংশ থাকলেও অবস্তি এলাকায় হার ছিল ৬৮ শতাংশ। ২০১৩ সালের চেয়ে এ হার বেড়েছিল মাত্র ২-৩ শতাংশ। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালে বস্তি এলাকায় জন্ম নিরোধকের আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার ৬৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে অবস্তি এলাকায় এ হার ৮২ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও নিপোর্টের জরিপের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ড. আমিনুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌করোনার সময় সচেতনতার কারণে অবস্তি এলাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলেছেন। অনেকে চিকিৎসকের কাছে যাননি। তবে বস্তি এলাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়েছেন। তখন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হারও কমে যায়। মহামারীর মধ্যে মানুষের মানসিক অবস্থা ও আচারে পরিবর্তন হয়। বিষয়টি বিয়ে, গর্ভধারণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওপর প্রভাব ফেলে।’

গাইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোরী প্রসূতিরা অপুষ্টিতে ভোগেন। পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কম। তাদের গর্ভের সন্তানও পুষ্টির অভাবে থাকে। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের জন্য কিশোরী শরীর ও মন প্রস্তুত থাকে না।

ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালেই অনেক মেয়ে গর্ভধারণ, সহিংসতা ও অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকে। এ বয়সের মেয়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক ও সামাজিক বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি থাকে। ফলে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত হন। দেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজনের একজন মেয়ে রুগ্‌ণ। জিংক, আয়োডিন ও আয়রনের মতো অণুপুষ্টির ঘাটতি থাকায় শতকরা ১১ জন মেয়ে রোগাপাতলা।

দেশের গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভধারণের ফলে ওই কিশোরীর ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ সময় মা হওয়ার জন্য শরীর ও মন প্রস্তুত নয়। একই সঙ্গে কম বয়সে যৌন কর্মকাণ্ড হওয়ায় জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। কম বয়সে বিয়ে ও গর্ভবতী হওয়ার ফলে পড়ালেখা এবং বিকশিত হওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: