নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকদের শরীরে নিয়মিতভাবে বেশ কয়েকটি টিকা প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো টিকা দেশেই তৈরি হয়। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী বিদেশী টিকা হোক আর স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত টিকাই হোক; এগুলো পরীক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো পরীক্ষাগার নেই সরকারের। ফলে পরীক্ষার জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশী পরীক্ষাগারের ওপর। তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠছে সরকার। আগামী জুলাইতে টিকা পরীক্ষার জন্য ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিকে (এনসিএল) প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেখানে করোনার টিকাসহ বিভিন্ন টিকার পরীক্ষা করা যাবে। প্রাথমিকভাবে সব টিকার পরীক্ষা করা না গেলেও ধীরে ধীরে পূর্ণ সক্ষমতার দিকে যাবে বাংলাদেশ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) জানিয়েছে, পরীক্ষার জন্য পূর্ণ সক্ষমতা তৈরি হলে বিশ্বের সব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এনসিএলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
সাধারণত দেশে সব ধরনের ওষুধ পরীক্ষা করে ডিজিডিএর ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি। আমদানি বা দেশীয় প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন করা ওষুধ ও টিকা দেশে প্রয়োগ এবং বাজারজাতের জন্য ডিজিডিএর অনুমোদন নিতে হয়। এনসিএলে পরীক্ষার পর অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। এ পরীক্ষাগারে সব ধরনের ওষুধ পরীক্ষা করা গেলেও টিকা পরীক্ষার পূর্ণ সক্ষমতা নেই। যার কারণে দেশে উৎপাদিত টিকাও বিদেশ থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মানবদেহে প্রয়োগের জন্য নয়টি টিকা উৎপাদন করছে। এগুলো হলো টিটেনাস, রেবিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, মেনিনগোকক্কাল, কলেরা, টাইফয়েড ও হাম-রুবেলা (এমআর)। সম্প্রতি এর মধ্যে দুটি টিকা পশুর শরীরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ব্যবস্থা হলেও সব টিকার পরীক্ষা করতে পারে না এনসিএল।
জানা গেছে, এনসিএল ওষুধ ও মাইক্রোবায়োলজির জন্য ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অ্যাক্রেডিটেশনও রয়েছে। তবে টিকা পরীক্ষার জন্য ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে এনসিএল। ডব্লিউএইচও টিকা পরীক্ষাগারকে চারটি বায়োসেফটি লেভেল অনুযায়ী বিবেচনায় নেয়। এর মধ্যে বায়োসেফটি লেভেল ৩ অর্জন হলে বেশির ভাগ টিকা পরীক্ষা করা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী জুলাইয় লেভেল ৩ অর্জন করবে বাংলাদেশ। ফলে তখন সব টিকা পরীক্ষার জন্য বিদেশমুখী হতে হবে না।
ডিজিডিএর কর্মকর্তারা জানান, একটি টিকা কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা করা হয়। টিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সক্ষমতা না থাকায় থাইল্যান্ডের পরীক্ষাগারের সাহায্য নেয়া হয়। তবে বায়োসেফটি লেভেল ৩ অর্জন হলে সব ধরনের পরীক্ষা এ পরীক্ষাগারে সম্ভব হবে। তখন করোনা প্রতিরোধী টিকাও পরীক্ষা করা যাবে।
২০২০ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এ প্রকল্প থেকে টিকা পরীক্ষাগারের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এর জন্য শুরুতে ডব্লিউএইচওর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কিনে দেয়ার কথা ছিল। পরে ইউনাইটেড নেশন অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসের (ইউএনওপিএস) মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এগুলো শিগগিরই পরীক্ষাগারে যুক্ত করা হবে। সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কেমিক্যাল রি-এজেন্ট ও যন্ত্রাংশ মেরামতের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় টিকা কতটুকু নিরাপদ ও কার্যকর সে বিষয়টি। কোনো টিকা পশু-পাখির শরীরে প্রয়োগের জন্য আবার কোনো টিকা মানবদেহে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মানুষের জন্য টিকা হলে তা ডব্লিউএইচওর মানদণ্ডে আর পশুর জন্য হলে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ওআইই) মানদণ্ডে তৈরি করা হয়। এজন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) ও সরকারের অনুমতি নিতে হয়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অণুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, পরীক্ষা নির্ভর করে মূলত টিকা কোন ধরনের তার ওপর। প্রতিটি জীবাণু প্রতিরোধী টিকার জন্য আলাদা পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। জীবাণুর স্বভাবের ওপর এগুলো নির্ভর করে। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের টিকার পরীক্ষা ভিন্ন। যেমন ব্যাকটেরিয়ার কোনো টিকার পরীক্ষার জন্য যতটা নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন, ভাইরাসের টিকার জন্য তার চেয়েও বেশি বায়োসেফটি লেভেলের পরীক্ষাগার প্রয়োজন। বাতাসে যেসব জীবাণু ছড়ায় তার টিকা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার উচ্চক্ষমতার হতে হবে। তবে বায়োসেফটি লেভেল ৩ অর্জন হলে বাংলাদেশ টিকা পরীক্ষায় অনেক এগিয়ে যাবে। যদিও সব ধরনের পরীক্ষা করা যাবে না। যেমন নিপাহ ভাইরাসের মতো প্যাথোজেন টিকার পরীক্ষা সম্ভব হবে না।
টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরীক্ষাই বড় সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, দেশে সরকারের পরিপূর্ণ টিকা পরীক্ষাগার থাকা জরুরি। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষাগার নির্মাণ করতে আগ্রহী হয় না, তাই সরকারের পরিপূর্ণ পরীক্ষাগার থাকা প্রয়োজন। এতে টিকা পরীক্ষার জন্য বিদেশনির্ভরতা কমবে।
আগামী জুলাইয়ের পর প্রায় সব পরীক্ষা বাংলাদেশে করা সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন ডিজিডিএর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, টিকার জন্য যেসব পরীক্ষা আমরা করতে পারতাম না, তা থাইল্যান্ড থেকে করিয়ে আনা হতো। তবে আশা করি জুলাইয়ের মধ্যে এনসিএল বায়োসেফটি ৩ লেভেল অর্জন করবে। তখন আর পরীক্ষার জন্য নমুনা দেশের বাইরে পাঠাতে হবে না।
সরকারের সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচি (ইপিআই) নারী ও শিশুদের ১৩টি রোগের জন্য ১১টি টিকা প্রয়োগ করছে। এছাড়া আরো কয়েকটি রোগ প্রতিরোধী টিকা প্রয়োগ করা হয়। চলমান করোনা মহামারীতে কভিড-১৯-এর টিকা দেশব্যাপী প্রয়োগ চলছে। ডব্লিউএইচওর অনুমোদনের পর দেশে আটটি টিকা জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে ডিজিডিএ। সক্ষমতা না থাকায় দেশে কোনো ধরনের পরীক্ষা হয়নি। এর মধ্যে করোনার টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের তিনটি বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্রস্তুতিও নিচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এনসিএলের সক্ষমতা বাড়লে এসব টিকার পরীক্ষা দেশেই করা সম্ভব হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠান।