দেশে গ্রাম থেকে নগরে অভিবাসন কমেছে

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গ্রাম থেকে মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। মূলত চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্যের কারণে এ অভিবাসন ঘটে। তবে নগরের সুবিধা গ্রামে বসে পাওয়া গেলে স্বাভাবিকভাবেই সে হার তখন কমে যায়। গত নয় বছরে দেশে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন কমেছে বলে সরকারের এক জরিপে উঠে এসেছে। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা এর পেছনে কাজ করেছে। একই সঙ্গে নগরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রসূতিদের সন্তান প্রসবের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে সি সেকশন বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) গতকাল ‘আরবান হেলথ সার্ভে-২০২১’ প্রকাশ করেছে। এতে নগরে অভিবাসন, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, জন্মনিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, প্রসূতিসেবাসহ নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ২০১৩ সালের নগর স্বাস্থ্য জরিপ বা আরবান হেলথ সার্ভের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়।

শহরাঞ্চলের বস্তি, বস্তির বাইরে ও শহরের উপকণ্ঠের (পৌর এলাকা) বাসিন্দাদের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় এ গবেষণায়। ১১টি সিটি করপোরেশনের বস্তি, বস্তির বাইরে বাসিন্দা ও পৌর এলাকা; যেখানে ৪৫ হাজারের বেশি বাসিন্দা রয়েছে সেসব এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মোট সাড়ে ৩৫ হাজার বাসিন্দাকে এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ১২-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরী-নারী ও ১৫-৫৪ বছর বয়সী কিশোর ও পুরুষ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের তথ্যও জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সিটি করপোরেশনের বস্তির পুরুষ বাসিন্দাদের মধ্যে শতকরা ৬৭ জনই ছিলেন অভিবাসী। ২০২১ সালে এসে এ হার নেমেছে ৫৮ জনে। একইভাবে সিটি করপোরেশন এলাকার বস্তির বাইরে বসবাসকারী পুরুষ বাসিন্দাদের শতকরা ৫৮ জন ২০১৩ সালে গ্রাম থেকে অভিবাসনের মাধ্যমে এসেছিলেন। আর ২০২১ সালে এ হার ৪৬ জন। পৌর এলাকায় ২০১৩ সালে অভিবাসী ছিলেন ৪৬, আর ২০২১ সালে ৩৫ জন। একইভাবে সিটি করপোরেশনের বস্তি এলাকার নারী বাসিন্দাদের মধ্যে শতকরা ৬৬ জন গ্রাম থেকে অভিবাসন করেছেন। ২০২১ সালে এসেছেন ৪৮ জন। সিটি করপোরেশনের বস্তি এলাকার বাইরে বসবাসকারী নারীদের মধ্যে ২০১৩ সালে শতকরা ৫৮ জন এবং ২০২১ সালে ৩৫ জন অভিবাসন হয়ে এসেছেন। আর পৌর এলাকায় ২০১৩ সালে ৩৩ ও ২০২১ সালে ১৪ জন অভিবাসী গ্রাম থেকে এসেছেন।

বস্তি এলাকায় অভিবাসনের মাধ্যমে আগতদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে ১ শতাংশ পুরুষ ও ৫০ শতাংশ নারী শহরে এসেছেন। আর চাকরির জন্য এসেছেন ৩৩ শতাংশ পুরুষ ও ১৭ শতাংশ নারী, বাবা-মায়ের জন্য এসেছেন ১০ শতাংশ পুরুষ ও ১৪ শতাংশ নারী, স্বচ্ছন্দজনক আয়ের জন্য ৩১ শতাংশ পুরুষ ও ১০ শতাংশ নারী, চাকরিতে বদলিজনিত কারণে ১৯ শতাংশ পুরুষ ও ৪ শতাংশ নারী, নদীভাঙনের কারণে ৩ শতাংশ পুরুষ ও ২ শতাংশ নারী গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন করেছেন।

বস্তির বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকায় নারীদের সবচেয়ে বেশি অভিবাসন হয়েছে বৈবাহিক কারণে। ৬৭ শতাংশ নারী এসেছেন এ কারণে। আর পুরুষের মধ্যে চাকরির কারণে সবচেয়ে বেশি এসেছেন ৩৬ শতাংশ। একইভাবে পৌর এলাকায় বৈবাহিক কারণে নারীরা এসেছেন ৮৩ শতাংশ আর ২৭ শতাংশ পুরুষ চাকরির কারণে এসেছেন।

কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিত্র এ জরিপের মাধ্যমে উঠে এসেছে মন্তব্য করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের সাবেক অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরু-উন-নবী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একশ লোকের মধ্যে কতজন অভিবাসনের মাধ্যমে এল তা সাধারণত অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দেখা যায়। নিপোর্ট যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মানুষের অভিবাসন কমার কথা বলেছে। তবে আমার মতে, একমাত্র যোগাযোগই কারণ নয়। বর্তমানে অভিবাসন কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ করোনা মহামারী। যদিও বিষয়টিকে জরিপে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি-জুন সময়কালে। এ সময়ে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল। ফলে গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রয়োজন বা প্রবণতা দুই কম ছিল। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আমরা ধারণা করি, বিভিন্ন কারণে গ্রামে আগের চেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। গ্রামঞ্চলে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ায় মানুষ হয়তো শহরে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না।’

প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে নির্পোট তার জরিপে বলেছে, দেশে বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান প্রসব। তবে অস্ত্রোপচারের (সি-সেকশন) মাধ্যমে এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় সিজারের হার কমলেও বাড়ছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা নেয়ার পরও সরকারি হাসপাতালের তুলনায় সিজারের হার দ্বিগুণ। সিটি করপোরেশনের মধ্যে বস্তি, বস্তির বাইরে ও পৌরসভায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় যেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ৪৪ শতাংশ, সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে এ হার ৪১ শতাংশ। সিটি করপোরেশনের বস্তি এলাকায় সরকারিতে যেখানে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের হার ৪৪ শতাংশ, বেসরকারিতে তা ৭৫ শতাংশ। সিটি করপোরেশনে বস্তির বাইরে সরকারি হাসপাতালে যেখানে ৫১, বেসরকারিতে এ হার ৮৭ শতাংশ এবং পৌরসভার সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সন্তান জন্মদানের হার ৩৭ শতাংশ হলেও বেসরকারিতে তা ৮৮ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) আওতাধীন তিন শ্রেণীর (সিটি করপেরেশনের বস্তি, বস্তির বাইরে ও পৌরসভা) প্রতিষ্ঠানে এ হার যথাক্রমে ২৫, ৫১ ও ৪৭ শতাংশ।

নিপোর্টের মহাপরিচালক মো. শাহজাহানের সভাপতিত্বে জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহান আরা বানু, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির প্রমুখ।

Source: Bonik Barta

Share the Post: