দেশে হৃদরোগে মৃত্যু সর্বোচ্চ হলেও চিকিৎসা সুবিধা কম

দেশে হৃদরোগের চিকিৎসার পরিসর বাড়লেও জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই অপর্যাপ্ত। সাম্প্রতিক বছরে কার্ডিয়াক সার্জারি বা হৃদরোগের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গুণগতমান ও উত্কর্ষ বেড়েছে। তবে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা, চিকিৎসা ব্যয় ও আঞ্চলিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলছেন, এ খাতের উন্নয়নে বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসে সতর্কতা এবং প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধমূলক সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে।

জাপানের কারিগরি সহায়তায় ১৯৮১ সালে দেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। জন্মগত সেকান্ডাম টাইপ আট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (হৃৎপিণ্ডের ওপরের কক্ষে ছিদ্র) আক্রান্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক কলেজ শিক্ষার্থী এ সার্জারির প্রথম সুবিধাভোগী। বর্তমানে বছরে অসংক্রামক রোগের কারণে যে-সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে দেশে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ হৃদরোগী। অন্যদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। এসব রোগীর মধ্যে বিশেষ করে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্তদের বেশি মৃত্যু ঘটে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে না পারার কারণে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। বিশ্বব্যাপী ৭৮ শতাংশ মানুষের অসুস্থতার কারণ অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা ও শ্বসনতন্ত্রজনিত অন্যান্য রোগ। প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে অসংক্রামক রোগাক্রান্ত ৬৭ শতাংশ। সংখ্যায় তা পৌনে ছয় লাখ। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যকই হৃদরোগী। অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত মৃতদের ৩০ শতাংশ হৃদরোগী, ১২ শতাংশ ক্যান্সার, ১০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ৩ শতাংশ ডায়াবেটিস এবং ১২ শতাংশ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ। বাকিরা মারা যান সংক্রামক রোগ বা আহত হয়ে।

দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার বিষয়টি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনায় উঠে এসেছে। এমনই একটি গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে। ‘ফোর ডিকেডস অব কার্ডিয়াক সার্জারি ইন বাংলাদেশ: আ নোবেল জার্নি দ্যাট স্ট্যাটেড উইথ দ্য হেল্প অব জাপান’ শীর্ষক এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু হলেও বর্তমানে যে সুবিধা রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। ১৭ কোটি মানুষের জন্য এ অপর্যাপ্ত সুবিধা জনগণের চিকিৎসা চাহিদা মেটাতে পারছে না। যদিও শুরুর পর তুলনামূলকভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি ও চিকিৎসা কেন্দ্র বেড়েছে। ১৯৯৭ সালে দেশে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় দুইশর বেশি। ২০১৬ সালে এসে তা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৩ হাজারে দাঁড়ায়। এসব কার্ডিয়াক সার্জারির মধ্যে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট (সিএবিজি) ৬৭ শতাংশ, ভালভ প্রতিস্থাপন ১২ শতাংশ ও জন্মগত সমস্যার কারণে ২০ শতাংশ। ২০১৭ সালে দেশে হৃদরোগে অস্ত্রোপচারের সুবিধা ছিল ২৫টি চিকিৎসা কেন্দ্রে, যা ২০২২ সালে ৩২টিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চারটি সরকারি, একটি সেনাবাহিনীর ও একটি স্বায়ত্তশাসিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৬টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সুবিধার ৯৫ শতাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকা বিভাগের ২৪টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিভাগের চারটি হাসপাতাল, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট বিভাগে একটি করে হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা রয়েছে।

ওই গবেষণার মুখ্য গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে হৃদরোগী কম তা ভাবার সুযোগ নেই। অসংক্রামক রোগে যারা মারা যান, তাদের তিনজনের একজনই হৃদরোগী। সারা বিশ্বেও তাই। আমরা সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারছি না। যারা দরিদ্র তারা হৃদরোগের চিকিৎসার কথা চিন্তা করতে পারেন না বা এসব রোগ নিয়ে ভাবেন না। আমাদের দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে ৬২টি কার্ডিয়াক সার্জারি হয়ে থাকে। সুবিধার অভাব ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে কার্ডিয়াক সার্জারি কম হয়।’

জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চসংখ্যক কার্ডিয়াক অস্ত্রোপচার করা প্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। যেটি সরকারি নয়। কার্ডিয়াকে সর্বোচ্চ অস্ত্রোপচার এখানেই হয়। ২০১৯ সালে মোট অস্ত্রোপচারের ২২ শতাংশই হয়েছে এ হাসপাতালে। এরপর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) হয়েছে ১১ শতাংশ এবং বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল করেছে ১০ শতাংশ। ঢাকার বাইরে হৃদরোগের অস্ত্রোপচার ২০০৪ সালে প্রথম শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনূস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৫০ জন কার্ডিয়াক সার্জারি রয়েছেন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এনআইসিভিডি ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়।

এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেড় থেকে দুই দশকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হৃদরোগের চিকিৎসা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে এসব সেবা নিশ্চিত করা না গেলেও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়া হয়। তবে সরকারি চারটি প্রতিষ্ঠানে কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়। শুধু গত বছরই সারা দেশে ১ লাখ ৪ হাজারের বেশি হৃদরোগের বিভিন্ন প্রসিডিউর হয়েছে। ধীরে ধীরে দক্ষ লোকবল তৈরি হচ্ছে। যত এনজিওগ্রাম হবে তত সংখ্যক কার্ডিয়াক সার্জারি করা যাবে। কার্ডিয়াক সার্জারি একটি সমন্বিত কাজ। কার্ডিয়াক সার্জারি করতে একটি টিম প্রয়োজন হয়। তাতে কার্ডিয়াক সার্জন, কার্ডিওলজিস্ট, অ্যানেসথিওলজিস্ট, টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ দল প্রয়োজন হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স মেডিসিন বলছে, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি বা হার্ট সার্জারি হলো হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে জড়িত যেকোনো অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি। হার্টের সমস্যার চিকিৎসার জন্য কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি সব সময় প্রয়োজন হয় না। চিকিত্সকরা হার্ট অ্যাটাক, রক্ত জমাট বাঁধা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, সরু ধমনী খোলা, রিং ও ভালভ প্রতিস্থাপন, জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিতে পারেন। কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির জন্য কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের প্রয়োজন হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে প্রকাশিত অপর একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে কার্ডিয়াক সার্জারিতে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। ভারতে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে অস্ত্রোপচার হচ্ছে ১১৩টি, পাকিস্তানে ১০৯টি, শ্রীলংকায় ২৬৮টি এবং নেপালে ৬৯টি। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় ৬৮টি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হৃদরোগ চিহ্নিত করার জন্য রোগ নিরীক্ষার সুবিধা বা প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, তা আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। তবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো গাইডলাইন নেই। করোনারি সিনড্রোম বা হার্ট অ্যাটাকের রোগী এলে প্রথমেই কী করতে হবে, তা নিয়ে আমরা গাইডলাইন তৈরি করতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের সাহায্য নিয়ে এটা তৈরি করা হবে। এতে আমাদের চিকিত্সকরা বুঝতে পারবেন ওই মুহূর্তে কী করা উচিত। হার্ট অ্যাটাক যেকোনো সময় হতে পারে। মানুষ ঠিকমতো হাসপাতালেও পৌঁছতে পারে না, ওষুধ পায় না। ওই ব্যবস্থাগুলো আমরা নেয়ার চেষ্টা করব।’

তিনি জানান, দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগের নির্দিষ্ট বিভাগ রয়েছে। বেশির ভাগ জেলা বা জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ও সিসিইউ (করোনারি পরিচর্যা কেন্দ্র) রয়েছে। সব জেলা হাসপাতালে এ ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কার্ডিওলজির কনসালট্যান্ট যারা আছেন তারাও সেখানে দীর্ঘমেয়াদি হার্টের রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন। মেডিসিনের কনসালট্যান্টরা আছেন তারাও তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা দিতে পারবেন। তবে হৃদরোগ প্রতিরোধে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত চলছে। উপজেলা হাসপাতালে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের (এনসিডিসি) কর্নার করা হয়েছে। সারা দেশে এ ব্যবস্থা করতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। যেসব দীর্ঘমেয়াদি রোগ হৃদরোগকে প্রভাবিত করছে, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথাযথ কার্যক্রম রয়েছে।’

চলতি মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০২০-এ বলা হয়েছে, হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্তদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৬০২ জন অ্যাকুইট মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন বা হার্ট অ্যাটাকে (হৃৎপিণ্ডের একটি অংশ পর্যাপ্ত রক্ত পায় না) আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২০ সালেও এ রোগে মারা গেছেন সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৬৪ রোগী।

হৃদরোগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, কার্ডিওভাসকুলার হূিপণ্ড ও রক্তনালির রোগগুলোর একটি সমষ্টি। বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও শারীরিক অক্ষমতার প্রধান কারণ হৃদরোগ। উচ্চরক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকির অন্যতম। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এক কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এ রোগে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০১৯ সালেও ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে। এসব মৃত্যু বিশ্বব্যাপী গোটা মৃত্যুহারের ৩২ শতাংশ। এর তিন-চতুর্থাংশের বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ঘটছে। বিশেষ করে তামাক সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, স্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং অ্যালকোহল গ্রহণের মতো আচরণগত অভ্যাস হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ।

এনআইসিভিডির কার্ডিয়াক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম মনজুরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাক হলে এনজিওগ্রাম করা হয়। এতে ব্লক ধরা পড়লে যদি দেখা যায় সেখানে রিং লাগানো যাচ্ছে না, রক্তনালির গোড়া বন্ধ বা একটা নালিতে অনেকগুলো ব্লক যাতে রিং কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে আমরা বাাইপাস সার্জারি করি। এনজিওগ্রাম ছাড়া বলার কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন ধরনের কার্ডিয়াক সার্জারি রয়েছে। তবে হৃদরোগ মানেই সার্জারি করতে হবে তা নয়।’

বাংলাদেশ জার্নাল অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থরোসিক অ্যানেসথিওলজির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারা দেশে ১১ ধরনের কার্ডিয়াক সার্জারি হয়েছে, সংখ্যায় যা নয় হাজারের বেশি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থরোসিক অ্যানেসথিওলজিস্টের (বিএসিএটিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালে যারা বুকে ব্যথা নিয়ে আসছেন, তাদের সঠিক রোগ নিরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে সিংহভাগই কোনো না কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত। সে অনুযায়ী, আমাদের চিকিৎসার সুবিধা কম। একই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের সংখ্যাও কম। যারা নতুন চিকিত্সক তৈরি হচ্ছেন তাদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।’

সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন মানুষের হৃদযন্ত্রে হঠাৎ করে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া বা অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমের কারণে। এ ধরনের রোগীরা শুরুতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রে রেফার হতে দেরি হয়। আর যারা সরকারি উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছেন তাদের যথাযথ চিকিৎসা কেন্দ্রে আসতে দেরি হয়েছে কম।

দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগের গবেষণা ও অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। তার মতে, বাংলাদেশে লোকসংখ্যার চেয়ে সম্পদের স্বল্পতা রয়েছে। দেশে হৃদরোগের রোগী যেমন বেশি, তেমনি এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব রোগ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তাও বেশি। একই সঙ্গে প্রতিরোধের ব্যবস্থা কম। দেশে যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা অকালে মারা যাচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তবে সেখানে এমন রোগী আসলে তা যেন দ্রুত সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে পাঠানো যায়।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অসংক্রামক রোগের মধ্যে হৃদরোগের ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি। এ রোগ যেসব কারণে প্রভাবিত হয়, সেসব ঝুঁকিগুলো কমানোর জন্য ব্যবস্থা তেমন একটি নেই। কাগজে-কলমে কার্যক্রম দেখানো হলেও বাস্তবিক অর্থে কার্যকরী পদক্ষেপ নেই।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হৃদরোগের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ অন্যতম। এ রোগগুলো নিজেও একটা রোগ আবার বিভিন্ন রোগকে প্রভাবিতও করে। ডায়াবেটিস রোগীদের চার গুণ বেশি হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, স্থূলতাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কার্ডিয়াক সার্জারি বা বিশেষায়িত সেবাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে শুরু থেকেই হৃদরোগ কমিয়ে আনা যায়। প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকলে চিকিৎসা পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা, মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত পর্যায়ে আমরা যেমন খরচ করছি, কিন্তু তা প্রতিরোধে শুরুতে চেষ্টা করছি না। শিশু ও মাতৃত্বে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রমে সফল হয়েছিলাম। জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসে আমাদের সতর্ক হতে হবে, অন্যথায় হৃদরোগ বা দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হচ্ছে। অনেক কম খরচে, সুবিধাজনক উপায়ে প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা যায়। আমাদের স্বাস্থ্যের বাজেট অপ্রতুল। এ বাজেটের ৩ থেকে ৫ শতাংশও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় খরচ করা হচ্ছে না। এটা বাড়ানো উচিত।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: