স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত পুষ্টি কার্যক্রমে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এতে উন্নতিও হয়েছে। তবে এখনো দেশের গর্ভবতী নারী, নবজাতক, শিশু, দুগ্ধদানকারী মাসহ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। গত প্রায় দেড় দশকে দেশে শিশুদের অপুষ্টির হার কমেছে। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট ও ধনী পরিবারের শিশুদের অপুষ্টির হারে উন্নতি খুবই কম। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
সংস্থাটি বলছে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বতা, কৃশতা ও কম ওজনের হার হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে দেশে শিশুদের খর্বতার হার ছিল ৫১ শতাংশ, কম ওজনের শিশুর হার ছিল ৪২ শতাংশ ও কৃশতার হার ছিল ১৫ শতাংশ। ১৪ বছর পর ২০১৭-১৮ সালে খর্বতার হার দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশ এবং কম ওজনের শিশুর হার ২২ শতাংশ। তবে সবচেয়ে কমেছে কৃশতায় ভোগা শিশুর হার। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা এ ধরনের শিশুর হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। প্রতি বছর খর্বতা কমার হার ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ, কম ওজন কমার হার ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর কৃশতা কমার হার ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যায়, অতিদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবার এবং বড় পরিবারের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি এবং তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমার হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ধনী এবং ছোট পরিবারের শিশুদের অপুষ্টি কমার হারে ধীরগতি রয়েছে।
এতে বলা হয়, চার সদস্যের কম পরিবারের শিশুদের খর্বতা কমার হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। চার থেকে ছয় সদস্যের পরিবারে তা ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর বড় পরিবারে খর্বকায় শিশুর হার দ্রুততার সঙ্গে কমছে। ছয়জনের বেশি সদস্য যেসব পরিবারে রয়েছে, সেসব পরিবারে বছরে ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে শিশুদের খর্বতা কমেছে। অন্যদিকে কৃশকায় শিশুর হার কমার ক্ষেত্রেও ছোট পরিবার সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। চার সদস্যের কম আকারের পরিবারে বছরে কৃশকায় শিশু কমার হার ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ হলেও চার থেকে ছয় এবং ছয় সদস্যের বেশি পরিবারে কমার হার বেশি রয়েছে। মাঝারি ও বড় পরিবারে বছরে শিশুদের কৃশতা কমার হার যথাক্রমে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ ও ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
গবেষণার তথ্যমতে, আয়ের ভিত্তিতে পরিবারগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এসব পরিবারের মধ্যে শিশুদের অপুষ্টি কমার হারে বৈচিত্র্য দেখা গেছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে প্রতি বছর অতিদরিদ্র পরিবারে শিশুদের কৃশতা কমার হার ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারে এ হার ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। মধ্যম আয়ের পরিবারে শিশুদের কৃশতা কমার হার সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের পরিবারে এ হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও ধনী এবং অতিধনী পরিবারের শিশুদের কৃশতা কমার হার কম রয়েছে। ধনী পরিবারের শিশুদের কৃশতা কমার হার বছরে ১ দশমিক ৯১ শতাংশ আর অতিধনী পরিবারে তা ২ দশমিক ৭ শতাংশ।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, ধনী ও ছোট পরিবার হলেই যে শিশুদের প্রতি খেয়াল রাখার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে এমনটি নয়। অপুষ্টি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। শিশুদের প্রতি যে খেয়াল রাখার কথা সেটা হয়ে উঠছে না নগরায়ণের ব্যস্ততার কারণে। এসব পরিবার সাধারণত সংশ্লিষ্ট কারোরই পরামর্শ নিতে চায় না। ফলে তারা শিশুদের অতি প্রক্রিয়াজাত (আল্ট্রা প্রসেসড) খাবার ও কোমল পানীয় দেয়। এসব খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ, ভিটামিন, প্রোটিন, ফসফরাসসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের ঘাটতি থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খুরশীদ জাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ছোট পরিবারে শিশুদের বাবা ও মায়েরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা গৃহপরিচারিকার ওপর নির্ভরশীল হন। এক্ষেত্রে তারা শিশুদের যে খাবার দিয়ে থাকে তাতে কতটুকু পুষ্টিগুণ রয়েছে তা চিন্তায় আনা হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বণিক বার্তাকে বলেন, ছোট ও ধনী পরিবারের বয়স্করা শিক্ষিত হলেও তারা সচেনতন নন। আমরা তাদের সচেতন মনে করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের মধ্যে পুষ্টিসম্মত খাবারের ধারণা কম। শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশে ব্যবস্থা রাখা জরুরি। কিন্তু নগরায়ণে ব্যস্ততার ফলে তাদের প্রতি সঠিক খেয়াল রাখা হয় না।
জাতীয় পুষ্টিসেবার (এনএনএস) লাইন ডিরেক্টর ডা. এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শিশুদের জন্য যে পরিমাণে কার্বোহাইড্রেড, প্রোটিন, মিনারেল, ফ্যাটসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান প্রয়োজন, তাতে ছোট ও ধনী পরিবার হিসাবে নেই। তারা মনে করে, ভালো ব্র্যান্ডের অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার ভালো। কিন্তু এসবে সুষম খাদ্যের উপাদান নেই।