দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সমাজে অবহেলা-অনাদরেই কাটে তাদের জীবন। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান—প্রতি ক্ষেত্রেই হয় বঞ্চনার শিকার। অথচ তারা বোঝা নয়, একটু সহযোগিতা পেলেই সম্পদে পরিণত হতে পারে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ শেষ পর্ব
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শারীরিক প্রতিবন্ধী মাসুম। নিজের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে পারেননি। ধীরে ধীরে সংসারের প্রয়োজনে বাড়ছিল ঋণ। এমন সময় তৃতীয় সন্তান প্রসব করেন তার স্ত্রী। সংসার চালাতে আর ঋণ পরিশোধের শেষ উপায় হিসেবে দেড় মাসের শিশুসন্তানকে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন এ দম্পতি। পরবর্তী সময়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে পুলিশ, কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হয় মাসুমকেও। শুধু যে শ্রমজীবী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই কর্মসংস্থানের সংকটে পড়েন তা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েও বেকার থাকতে হয় অনেককে। তেমনই একজন আমিরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সেরিব্রাল পালসি থাকার কারণে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো তাকে কাজে নিতে অনীহা দেখায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকাই এ সমস্যার মূল কারণ।
একটি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান উপাদান হিসেবে ধরা হয় কর্মসংস্থানকে। কিন্তু আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় না প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৩ শতাংশেরও কম সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ পায়। এছাড়া অর্ধেকের বেশি প্রতিবন্ধী নিজ উদ্যোগে পরিচালিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের আইন, নীতি ও কর্মসূচি রয়েছে। তবে এসব বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে তাদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যেসব প্রতিবন্ধী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তারা পুরোপুরি নিজ ইচ্ছায় ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং সচেতনভাবে কাজে যোগ দিতে পেরেছেন। দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধীদের বড় একটি অংশ বাদ পড়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি, তেমনি কর্মক্ষেত্রগুলোও প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী নয়।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি) প্রকাশ করে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবন্ধীদের ৬৬ শতাংশ কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেনি। যারা কাজ পেয়েছে তাদের মধ্যে আবার শতকরা হিসেবে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে খুবই কম। মাত্র ২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রতিবন্ধী সরকারি কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে।
বিবিএস বলছে, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী যেসব প্রতিবন্ধী বিভিন্ন কাজ করছে তাদের অধিকাংশই স্বনিয়োজিত। এ হার ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। একইভাবে নিজেদের গৃহস্থালি বা পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছে ১৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) কাজ করছে শূন্য দশমিক ৬৮, স্থানীয় সরকার অথবা সরকারের প্রকল্পে কাজ করছে শূন্য দশমিক ৬৩ ও সরকারি অথবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে মাত্র ২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বিভাগভিত্তিক হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে রংপুরের প্রতিবন্ধীরা। বিভাগটিতে এ হার হচ্ছে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে বরিশালে ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১, ঢাকায় ৩, খুলনায় ২, ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৪২ ও রাজশাহীতে ৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। সিলেটে এ হার শূন্য।
১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে গবেষণা ও সহযোগিতামূলক কাজ করছে সুইড বাংলাদেশ। সংস্থাটির বাংলাদেশের মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলামের মতে, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অবহেলা রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কম পাচ্ছে, এজন্য সরকারের সেই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের আইন, নীতিমালা ও প্রকল্প থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন ও নীতির দিক দিয়ে উন্নত দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। তবে গলদটা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেই। বিবিএস যে পরিসংখ্যান দিয়েছে বাস্তব চিত্র আরো কম। দেশের দৃষ্টি, শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীরা যারা নিজ ইচ্ছায় লেখাপড়া শেষ করতে পারছে তারা কোনো না কোনো কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পদে পরিণত হতে পারত। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থার প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করার কথা। তাদের উপযোগী করে তুলতে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। তবে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এসব সংস্থা কেবল সুরম্য ভবনে বসে কাগজে-কলমে হিসাব দেখায়।’
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ অনুযায়ী জন্মগতভাবে, রোগাক্রান্ত হয়ে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে, অপচিকিৎসা বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ কিংবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী বলা হয়েছে। অর্থাৎ স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম ব্যক্তিরাই প্রতিবন্ধী। এছাড়া ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক, মানসিক অসুস্থতাজনিত, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
জরিপে বিবিএস বলেছে, দেশে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩ দশমিক ২৮ ও নারী ২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে মাত্র ৩৪ শতাংশ, যার মধ্যে পুরুষ ৪৮ ও নারী ১৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের ৩৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারলেও শহরাঞ্চলে এ হার ২৬ শতাংশ।
অবশ্য কাজে যুক্ত না হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরই দুষছে বিবিএস। জরিপের ফলাফলে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক মনোভাব ও অভ্যাস বা আচরণের কারণে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীই মূলধারার জাতীয় উন্নয়ন উদ্যোগ থেকে বাদ পড়ে যায়। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সব পুরুষ ও নারীর জন্য পূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের জন্য উৎসাহিত করা।
তবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী শারীরিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন আমিরুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। শৈশবে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়ে হাত ও পায়ের শক্তি হারান তিনি। বণিক বার্তাকে দুটি চাকরির সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা বলেন আমিরুল। তিনি জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাক্ষাৎকার দিতে গেলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের নেতিবাচক মনোভাবের মুখোমুখি হন।
আমিরুল বলেন, ‘বোর্ডের সদস্যরা আমাকে ইতিবাচকভাবে নেননি। তারা আমাকে জানান, আমি শ্রেণীকক্ষে বোর্ডে লিখতে পারব না। আবার স্কুলটি হুইলচেয়ারে চলাচলের উপযোগী নয়। ক্লাসে ছোট শিক্ষার্থীদের আমি সামলাতে পারব না। আমি তাদের আমার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছি। একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েও একই অবস্থা দেখি। তাদের কথা হলো, আমি অফিস সামলাতে পারব না। ছোট পদের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলে বলা হয়, কাজ বেশি, আমি করতে পারব না। আর বড় পদের জন্য গেলে বলা হয়, আমি সব দায়িত্ব সামাল দিতে পারব না। কোথাও কোথাও কোটা নেই। চাকরির পরীক্ষায় লিখতে সহায়তা করার জন্য রাইটারও দেয়া হয় না।’
এসব বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, ‘সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের সরকার প্রতিবন্ধীবান্ধব সরকার। প্রতিবন্ধীদের জন্য এ সরকারের আগে কেউ বিশেষ পদক্ষেপ বা কার্যক্রম নেয়নি। যারা ওইসব বলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
জরিপে সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের কম হারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার কোটার ব্যবস্থা করেছে। তারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কাজও করছে।’