নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল

দেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেয়ার লক্ষ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় এ হাসপাতালে সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে অনেক বেশি। ফলে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হলেও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটির বিশেষায়িত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্তরা। উদ্বোধনের প্রায় দেড় বছরেও পরিপূর্ণভাবে সেবা চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ৭৫০ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে রোগী ভর্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০০ শয্যায়। মোট সুবিধার এক-তৃতীয়াংশও নিশ্চিত করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ এতে ব্যয় হয় দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ছিল দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ঋণ, সরকারি সহায়তা ৩৩৮ কোটি ও জমির মূল্য হিসেবে ১৭৫ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়ন।

উদ্বোধনের পর চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের সংকটের কারণে বহির্বিভাগ ও রোগী ভর্তির কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। এর প্রায় তিন মাস পর ওই বছরের ডিসেম্বরে চালু হয় বহির্বিভাগের পরামর্শ (কনসালটেশন) সেবা। সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়ে স্বল্প পরিসরে রোগী ভর্তি কার্যক্রম চালু হয়েছে বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিপূর্ণভাবে হাসপাতালটি চালু করতে আরো ছয় মাস সময় লাগবে।

সরকারের অর্থায়নে নির্মিত এ হাসপাতালের কনসালটেশন, রোগ নির্ণয় ও অন্যান্য ফি সরকারি হাসপাতালের চেয়ে চিকিৎসার ধরন ভেদে কয়েকশ শতাংশ বেশি। নিম্ন মধ্যবিত্তরা বিএসএমএমইউ হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে সরকারি জেনে। তবে চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে তাদের মোটা অংকের অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে আশাহত হয় সেবাপ্রত্যাশীরা। তুলনামূলকভাবে সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের চেয়ে বিএসএমএমইউর চিকিৎসা ব্যয় বেশি। আবার বিএসএমএমইউ হাসপাতালের চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি সুপার হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা ও বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পরামর্শ পাচ্ছে রোগীরা। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত হাসপাতালে যে কনসালটেশন দেয়া হয় তাতে একজন অধ্যাপক ৬০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ৪০০ ও সহকারী অধ্যাপক ৩০০ টাকা ফি নিচ্ছেন। আর বৈকালিক কনসালটেশনের জন্য অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের ফি যথাক্রমে ১ হাজার, ৮০০ ও ৬০০ টাকা। শুধু পরামর্শক ফি নয়, বাড়ানো হচ্ছে রোগ নির্ণয় ফি। যদিও এ ফি নিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ তুলেছেন আপত্তি।

জানা যায়, হাসপাতালটি উদ্বোধনের বছর ডিসেম্বরে অর্থ কমিটির সভায় ফি নির্ধারণের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটি মানছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হাসপাতালে বৈকালিক কনসালটেশনে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের ফি যথাক্রমে ৬০০, ৪০০ ও ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এসব ফি থেকে ১০০ টাকা করে পাবে বিশ্ববিদ্যালয়। আর রোগ নির্ণয়ের ফি বিএসএমএমইউ হাসপাতালের বর্তমান হারের চেয়ে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বেশি হবে।

বিশেষায়িত এ হাসপাতালে পাঁচটি কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো জরুরি চিকিৎসা ও ট্রমা কেন্দ্র, কিডনি রোগ ও প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কার্ডিওভাসকুলার রোগ ও স্ট্রোক কেন্দ্র এবং হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়াটিকস, হেপাটোলজি ও যকৃৎ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ, শিশু স্বাস্থ্য, নেফ্রোলজি, ইউরোলজি, রেসপিরেটরি মেডিসিন, হৃদ্‌রোগ, কার্ডিয়াক সার্জারি, নিউরোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি ও প্যানক্রিয়াটিকস, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা, চক্ষুরোগ, সার্জিক্যাল অনকোলজি ও নিউরোসার্জারি সেবা। এছাড়া ১৪টি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি, ২২টি ভিআইপি ও ২৫টি ডিলাক্স কেবিন রয়েছে বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পদস্থ ব্যক্তি বণিক বার্তাকে জানান, এ হাসপাতাল সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। এটা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। এর ফি এমন নির্ধারণ করা যাবে না, যাতে সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। হাসপাতালে সকাল বা বিকালে একই ফি করার কথা। সেক্ষেত্রে সকালে যেসব চিকিৎসক কনসালটেশন করবেন ওই ফি থেকে তারা কোনো অংশ পাবেন না। বিকালে কনসালটেশন করলে চিকিৎসকরা ফির ৬০ শতাংশ পাবেন।

তারা জানান, কর্তৃপক্ষের ধারণা এ হাসপাতাল সবার জন্য নয়। বিত্তবানদের জন্যই এ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন। তবে স্বায়ত্তশাসন ও অর্থায়ন সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটাই চলে সরকারের টাকায়। দুই হাসপাতালের ফি এক হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে রাজি হয়নি। বিএসএমএমইউ হাসপাতালে বহির্বিভাগের টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা। আর বৈকালিক কনসালটেশন ফি ২০০ টাকা। তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার হাসপাতালের ফি তারও কয়েক গুণ বেশি।

এদিকে হাসপাতালটির কার্যক্রম পুরোপুরি চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে লোকবল সংকটকে উল্লেখ করেছে হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মো. রসুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রয়োজন অন্তত ২ হাজার ৭০০ জন। বর্তমানে ৩৮৪ জন জনবল রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৪৫০ শয্যা চালু করার প্রক্রিয়া রয়েছে। সেজন্য জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।’

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালুর পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ ধরনের বিশেষায়িত পরামর্শ নিয়েছে সাড়ে ৪১ হাজার রোগী। পরীক্ষাগারে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে প্রায় এক লাখ। রেডিওলজি কেন্দ্রে পৌনে সাত হাজার, কার্ডিওভাসকুলার ও স্ট্রোক কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার, হেপাটোবিলিয়ারি, হেপাটোলজি ও লিভার কেন্দ্রে এক হাজার, কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে ২৭৫ সেবা দেয়া হয়েছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৬৩৮ রোগী। এর মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে এখন পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১৬০ জন দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ চিকিৎসক, ২৯ কর্মকর্তা, ৫৬ নার্স ও ২৩ জন টেকনোলজিস্ট। তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় এক-দেড় মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে এসব ব্যক্তির সিংহভাগকেই এ হাসপাতালে যুক্ত করা হয়নি।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জুলফিকার রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল প্রকল্পটি সঠিকভাবে শেষ করা। আমি প্রকল্পের সব কার্যক্রম শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালকে বুঝিয়ে দিয়েছি। প্রকল্পের অধীনে যেসব ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল তাদের কেউ কেউ এ হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত নেই। এটা কর্তৃপক্ষের বিষয়। কর্তৃপক্ষ যে তালিকা প্রস্তুত করে আমাদের দিয়েছিল তাদেরই আমরা প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছিলাম। তাদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রকল্প থেকে বহন করা হয়েছে। যে লক্ষ্যে এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা পূরণ হচ্ছে না। এ হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এ প্রকল্প স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমি তাদেরই নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলাম।’

তবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাদের সিংহভাগই হাসপাতালটিতে সংযুক্ত রয়েছেন বলে দাবি করেছেন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. আব্দুল্লাহ আল হারুন। তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্যে ১২৯ জনই এ হাসপাতালে কাজ করছেন। যারা এখানে নেই তারা বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রয়েছেন। প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের আবার এখানে পদায়ন করবে কর্তৃপক্ষ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৪৫০ শয্যায় রোগী ভর্তি চালু করতে হলে আমাদের মোট ১ হাজার ২৫০ জনবল প্রয়োজন। আশা করি, আগামী জুলাইয়ে হাসপাতাল পুরোপুরি চালু করতে পারব। লোকবল সংকটের কারণে এখন পুরোপুরি সেবা দেয়া যাচ্ছে না।’

সার্বিক বিষয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৪৫০ শয্যা চালুর প্রস্তুতি নিয়েছি। সেজন্য নতুন করে চার শতাধিক লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া রয়েছে। আগামী জুলাইয়ে পরিপূর্ণভাবে এ হাসপাতাল চালু হবে। মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দ ছিল না, সেজন্য এতদিন নিয়োগ দেয়া যায়নি। এ হাসপাতালে ফি বেশি, তার কারণ এখানকার সবকিছুই উচ্চমানের। গরিব লোকদের জন্য আমাদের বিএসএমএমইউ হাসপাতাল রয়েছে।’

সরকারি অর্থায়নের কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা খরচ এত বেশি নির্ধারণ করতে পারে না বলে মনে করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, চিকিৎসাসেবা এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ওই হাসপাতালের সব খরচ, বেতন সরকারের রাজস্ব থেকে দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ ফি নির্ধারণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিশেষায়িত সেবায় খরচ বেশি সত্যি, তবে তা সব মানুষের সক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। আবার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ে এতটা পার্থক্য থাকা সমীচীন নয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: